April 24, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, October 13th, 2021, 7:50 pm

অপরাধ বৃদ্ধিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে মহামারী

প্রতীকী ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশে নতুন নতুন অপরাধ বাড়ছে ক্রমাগত। যুগের পরিবর্তনের সাথে অপরাধের ধরণেও আসছে পরিবর্তন, তবে যুগ যুগ ধরে চলে আসা অপরাধগুলো নিঃশেষ হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে কিডনি কেনা-বেচার মত অপরাধও এখন সংঘটিত হচ্ছে। সোমবার কিডনি কেনা-বেচার চক্রের ৫ সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। জানা যায়, সোমবার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে জয়পুরহাট ও রাজধানীর নর্দ্দা এলাকা থেকে অভিযুক্তদের আটক করেছে র‌্যাব। করোনা মহামারির সময় চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা, ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন এই পাঁচ ধরনের অপরাধ বেড়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া ২০২০ সালের সারা দেশের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে র‌্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের খোঁজ পায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে র‌্যাব। এর ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-৫, র‌্যাব-২ ও র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার যৌথ অভিযানে জয়পুরহাট ও ঢাকার নর্দ্দা এলাকা থেকে মো. শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ (৩৬), মো. মেহেদী হাসান (২৪), মো. সাইফুল ইসলাম (২৮), মো. আবদুল মান্নান (৪৫) এবং মো. তাজুল ইসলামকে (৩৮) আটক করা হয়। র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে ৪টি পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র, ৫টি মোবাইল ফোন ও দেশি-বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই চক্রের সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন। তারা ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে এই কর্মকা- চালায়। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর আইনশৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। এর মধ্যে ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ত্রাস সৃষ্টি, সম্পত্তি দখল, গবাদিপশু চুরিসহ ছয় ধরনের অপরাধ বেশি বেড়েছে। পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, বৈশ্বিক এই মহামারিতে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধ বাড়তে পারে, সেটা কিছুটা অনুমিত ছিল। সেদিকে নজর রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে। তবে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি এবং বিকৃত যৌনাচারের ঘটনা পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. সোহেল রানার ভাষ্য, করোনাকালে প্রান্তিক পেশাজীবীসহ অনেক মানুষের স্বাভাবিক আয়ের পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের চলাফেরাও সীমিত। তাই অর্থ সম্পত্তি ও মানুষের শারীরিক উপস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধের পরিসংখ্যানে পরিবর্তন এসেছে। তবে সার্বিক অপরাধের সংখ্যা কমেছে। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মার্চ থেকে অক্টোবরের তুলনায় ২০২১ সালের একই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধের সংখ্যা বেশি। পুলিশের খাতায় আইনশৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধ বলতে বোঝানো হয়, চাঁদা দাবি, মালামাল দাবি বা আদায় করা বা আদায়ের চেষ্টা করা, যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা বা গতিপথ পরিবর্তন করা, যানবাহনের ক্ষতি সাধন করা, সম্পত্তি বিনষ্ট বা ভাঙচুর করা, ছিনতাই বা জোর করে কেড়ে নেওয়া, ত্রাস সৃষ্টি করা, দরপত্রে বাধা দেওয়া ও দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা ইত্যাদি। ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধের সংখ্যা ছিল ৩২০ টি, ২০২০ সালে এই অপরাধ দাঁড়ায় ৫৯৮টিতে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চাঁদা দাবি বা আদায়ের চেষ্টা, ছিনতাই ও ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টায় করা অপরাধের সংখ্যা। ২০১৯ সালে চাঁদা বা মালামাল দাবি বা আদায়ের চেষ্টায় মামলা হয়েছিল ৬৭টি। ২০২০ সালের একই সময়ে মামলা হয়েছে ১০৩টি। চাঁদা দাবি আদায় বা আদায় চেষ্টায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা অঞ্চলে (রেঞ্জে)। এর সংখ্যা ২৩। এরপরই রাজশাহী অঞ্চলের অবস্থান। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় এ সময়ে চাঁদা দাবির মামলা হয়েছে ১২টি। ত্রাস সৃষ্টির মতো অপরাধের ঘটনা সবচেয়ে বেশি বরিশাল অঞ্চলের ছয়টি জেলা বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও ভোলায়। ত্রাস সৃষ্টি বলতে বোঝানো হয় বাড়িঘর, দোকানপাট, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, যানবাহন বা প্রতিষ্ঠানে পরিকল্পিত বা আকস্মিকভাবে একক বা দলবদ্ধভাবে শক্তির মহড়া, দাপট দেখিয়ে ভয়ভীতি বা ত্রাস সৃষ্টি করা, বিশৃঙ্খলা বা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্ট করা। করোনাকালে গবাদিপশু চুরির ঘটনাও বেড়েছে। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় গবাদিপশু চুরির মামলা হয়েছিল ৬০৮টি। ২০২০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮১৪টি। চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১৫৫টি, রংপুর রেঞ্জে ১২৯টি ও খুলনা রেঞ্জে ১২৪টি মামলা হয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের মামলা হয় সাড়ে চার হাজার। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৩৩১। করোনাকালে ডিএমপির বাইরে ঢাকা রেঞ্জের ১৭ জেলায় ৭৪৪টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। আর ডিএমপি এলাকায় হয় ৩৭২টি। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমানের ভাষ্য, যৌন সহিংসতা, ধর্ষণ ও বিকৃত যৌনাচারে জড়িয়ে পড়ার একটা অন্যতম কারণ পর্নোগ্রাফি। অন্যান্য অপরাধ বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি জানান, ঐতিহাসিকভাবে মহামারি, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো পরিস্থিতিতে অপরাধের চিত্র বদলায়। বিশেষত, যাঁরা অর্থনৈতিক ঝুঁকি ও মানসিক অশান্তিতে আছেন, তাঁদের একটি অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। একটি অংশ অপরাধের শিকার হন। অপরাধে জড়িয়ে পড়েন প্রধানত অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক অবস্থায় থাকা মানুষ। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় কিশোর অপরাধের ঘটনাও বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। মহামারীতে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে কিশোর অপরাধীরা সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এজন্য তারা ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ভূমিকা রাখছে টিকটকও। সম্প্রতি গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় দুই পরিবারের সদস্যদের ওপর নৃশংস হামলার সঙ্গে জড়িত কিশোর গ্যাং ‘ডি কোম্পানি’র পৃষ্ঠপোষক বাপ্পী ওরফে লন্ডন বাপ্পী এবং নীরব ওরফে ডন নীরবসহ গ্রুপটির ১২ জন সদস্যকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-১)। এ ছাড়া ১৭ জুন ঢাকার মিরপুর মডেল থানাধীন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১টি চাইনিজ কুড়াল, ১টি ফোল্ডিং চাকু, ১টি চাপাতি, ৫০ পিস ইয়াবাসহ এলাকায় ভীতি ছড়ানোর জন্য তিন কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেফতার কিশোররা মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ইভ টিজিংসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। প্রাপ্ত তথ্যে, কিশোর অপরাধীদের বয়স ১৪ থেকে ১৮। অথচ এই বয়সেই ধারালো ও স্বয়ংক্রিয় দেশি-বিদেশি অস্ত্র চালানো শিখে নিয়েছে। কেউ চুরি আবার কেউ ছিনতাই করছে। বয়সে ছোট হলেও পেশাদার সন্ত্রাসীর মতোই তাদের আচরণ। প্রয়োজনে মানুষ খুন করতেও তাদের হাত কাঁপে না। কিশোর বখাটেদের কেউ কেউ যৌন হয়রানিতে জড়াচ্ছে, আবার তারা সক্রিয় আছে সাইবার অপরাধেও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, সাধারণত এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের কাজেই প্রভাবশালীরা কিশোর অপরাধীদের বেশি ব্যবহার করছে। বিগত কয়েক বছরের অপরাধের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, মাদক সেবন ও মাদক বিক্রির মতো অপরাধগুলোতেও শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে। জানা যায়, পাড়া-মহল্লা ও বস্তির ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং ভাসমান পথশিশু ও টোকাইরা কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোররাই অপরাধে জড়াচ্ছে বেশি। এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের ভাষ্য, ‘ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে শিশুরা সহিংস অনেক কনটেন্ট দেখে ফেলছে। বর্তমানে শিশুরা যে ভিডিও গেম খেলছে এর বেশির ভাগই সহিংসতামূলক। এ গেমগুলো শিশুদের সহিংস করে তুলছে। শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার দুটো ক্ষেত্রের একটি হচ্ছে পরিবার, অন্যটি তার স্কুল। আশঙ্কা করছি বেশ কিছু পরিবারের অভিভাবকের শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য যে ভূমিকা পালন করার কথা, তা তারা করছেন না। আবার বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও অনেক প্রতিযোগিতামূলক। সেখানে ব্যক্তিত্ব ও জীবন গঠনের শিক্ষা অনুপস্থিত। এসব বিষয়ই শিশুকে সহিংস করে তুলছে।’