April 19, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, October 12th, 2021, 7:25 pm

ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত অভিনেতা ড. ইনামুল হক

নিজস্ব প্রতিবেদক:

একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রখ্যাত নাট্যকার, অভিনেতা, লেখক, অধ্যাপক ড. ইনামুল হককে ফুলেল শ্রদ্ধায় বিদায় জানালো তার সহকর্মী-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষরা। মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) সকাল সোয়া এগারোটায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার মরদেহ নিয়ে এলে বিভিন্ন স্তরের সংগঠন ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় শ্রদ্ধা জানান- তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ, আবুল হায়াত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান, অভিনেত্রী শাহনাজ খুশি, তানজিকা আমিন, নাতাশা হায়াত, মোমেনা চৌধুরী, নাট্যকার বৃন্দাবন দাস, অভিনেতা মীর সাব্বির, ফারুক আহমেদ, নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার, পিকলু চৌধুরী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অসীম কুমার উকিল ও সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ বেতার-টেলিভিশন শিল্পী সংস্থা বাঙালি সাংস্কৃতিক বন্ধন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ, ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘গভীর শ্রদ্ধা ড. ইনামুল হকের অমর স্মৃতির প্রতি, তার বিদেহী আত্মার প্রতি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একজন গর্বিত শিক্ষার্থী ছিলেন। এরপর অনেক বছর তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি নিজেকে যেভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সাথে নিয়োজিত রেখেছেন, একজন অভিনেতা হিসেবে, নাট্য নির্দেশক হিসেবে, এমনকি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবনে তিনি অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। সে কারণেই ড. ইনামুল হক শুধু একজন অধ্যাপকই নন, একজন সমাজকর্মী, সমাজ সংস্কারক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সেই হিসেবেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশ একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই কঠিন সময়ে আমরা হাসতে ভুলে গেছি। ইনামুল হক মানুষকে সব সময় আনন্দ দিয়ে থাকতেন। তিনি হাসতে শিখিয়েছেন। তার প্রস্থানে দুঃখের মধ্যে সামান্যটুকু আনন্দ কে দেবে, আমি জানি না। অভিনয় জগত, শিক্ষাজগত সর্বত্র সব মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে তিনি আমাদের কথা বলতে শিখিয়েছেন। আমি অন্তর থেকে তাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। অনেকদিন তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’
ড. ইনামুল হকের মেয়ে হৃদি হক বলেন, ‘তিনি আসলে সবার ছিলেন। ওনার ভাবনায়, চিন্তায়, চেতনায় ছিলো বাংলাদেশ ও মানুষ। এর বাইরে কিচ্ছু ছিল না। তিনি আমাদের সকলের নাট্যগুরু, নাট্যপ্রাণ মানুষ। সারাজীবন নাটক, থিয়েটার, শিল্পচর্চা, সেই গণআন্দোলনের সময় থেকে শেষদিন পর্যন্ত বাবা অনুবাদের কাজ করে গেছেন। যেই ভালোবাসা তিনি মানুষকে দিয়েছিলেন, মানুষও তাকে সেই ভালোবাসা দিচ্ছেন।’
অভিনেতা ও ড. ইনামুল হকের জামাতা সাজু খাদেম বলেন, ‘এখনকার মানুষ বাচ্চা নেওয়ার জন্য কেউ আমেরিকা চলে যায়, কানাডায় চলে যায়। আমার শ্বশুর যখন পিএইচডি করতে ম্যানচেস্টারে গিয়েছেন তিনি তখন বিবাহিত ছিলেন। চাইলে তিনি সেখানে সন্তান নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার সন্তান হবে স্বাধীন বাংলাদেশে। এইরকম একজন দেশ প্রেমিককে আমরা হারিয়েছি, সেটা এই দেশের গ্রেট লস, আমাদের সবার লস। সবাই ওনার জন্য দোয়া করবেন।’
অভিনেতা মীর সাব্বির বলেন, ‘তিনি আমাদের সবার শিক্ষক ও গুরু। একজন অভিনেতা হিসেবে যেমন অগ্রজকে হারিয়েছি, তেমন ছাত্র হিসেবে শিক্ষককে। আমি যে সংগঠনে ছিলাম, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তার কাছ থেকে যেমন জেনেছি, শিখেছি তেমনি পিতার আদরও পেয়েছি। চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। কিংবদন্তির কখনও প্রস্থান হয় না।’
এদিকে, ইনামুল হককে দুপুর ১ টায় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নেওয়া হয়। এরপর বাদ জোহর নগরীর বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় এই নাট্যজনকে।
বর্ষীয়ান এ অভিনেতা গত সোমবার সকালে নিজ বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর বেলা ৩টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলের ইসলামি ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। জানা যায়, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বেইলি রোডের বাসায় তাঁর প্রথম জানাজা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শিল্পকলা একাডেমিতে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নেওয়া হয়। রাতে ফ্রিজার ভ্যানে মরদেহ বাসার কমপাউন্ডেই রাখা হয়। ড. ইনামুল হকের জন্ম ফেনীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। দীর্ঘকাল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করার প্রয়াসে বিভিন্ন আন্দোলনমুখী নাটকে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে আইয়ুব খানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তৎকালীন অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন নাট্যচর্চাকে হাতিয়ার করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সৃজনীর ব্যানারে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ট্রাকে ট্রাকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পথনাটক করেন। ব্যক্তিজীবনে ড. ইনামুল হকের দাম্পত্য সঙ্গী বরেণ্য নাট্যজন লাকী ইনাম। তাঁদের সংসারে দুই মেয়ে হৃদি হক (স্বামী লিটু আনাম) ও প্রৈতি হক (স্বামী সাজু খাদেম)। ড. ইনামুল হক ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০১৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।