April 20, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, July 6th, 2021, 8:15 pm

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বদলির তালিকায় মৃত চিকিৎসকও!

নিউজ ডেস্ক :

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিতে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকদের গণবদলি করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। গত সোমবার (উপ-সচিব জাকিয়া পারভীন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বদলি করা হয় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জীবেশ কুমার প্রামাণিক স্বপনকেও। আদেশে তাকে আগামী ৭ জুলাইয়ের মধ্যে বগুড়া ২৫০ শয্যা মোহাম্মদ আলী জেলা হাসপাতালে যোগ দিতে বলা হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. জীবেশ কুমার প্রামাণিক স্বপন গত ৬ জানুয়ারি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৩১তম ব্যাচের প্রাক্তন এ শিক্ষার্থী ২২তম স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। শুধু তিনিই নন, তার মতো ফেরদৌস আরা শেখ নামে রংপুর মেডিকেল কলেজের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের আরও এক মৃত চিকিৎসককেও বদলি করা হয়েছে। এ ছাড়া চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া রংপুর মেডিকেল কলেজের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মমতাজ বেগম ও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. গিয়াসউদ্দিনকেও বদলি করা হয়েছে আদেশে। জাকিয়া পারভীন স্বাক্ষরিত ২৬ পৃষ্ঠার পৃথক প্রজ্ঞাপনে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মেডিকেল কলেজের শিক্ষককে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, সদর ও উপজেলা হাসপাতালে সংযুক্তিতে বদলির তথ্য পাওয়া গেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোভিড-১৯ সুষ্ঠুভাবে মোকাবিলা ও জনসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার/স্বাস্থ্য সার্ভিসের কর্মকর্তাদের তাদের নামের পাশে কর্মস্থলে সংযুক্তিতে বদলি করা হয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গণবদলির ঘটনায় সাধারণ চিকিৎসকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবীণ শিক্ষকদের এ গণবদলির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ মন্তব্য করতে দেখা গেছে চিকিৎসকদের। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) একাধিক শীর্ষ নেতা বলেন, দেশের সরকারি সব মেডিকেল কলেজে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা চলছে। করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য যাদের বদলি করা হয়েছে তারা মূলত মেডিকেল কলেজের মৌলিক বিভিন্ন বিষয়ের (এনাটমি, ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি, ফরেনসিক মেডিসিন) অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক এবং লেকচারার হিসেবে শিক্ষকতা করেন। করোনা চিকিৎসার ব্যাপারে তারা অনভিজ্ঞ। তারা চলে গেলে ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেবে। যে বদলির আদেশ হয়েছে সেখানে তাদের নামের পাশে পদবি দেয়া হয়নি, শুধু নাম আর রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেয়া হয়েছে, যা রীতিমতো অপমানজনক। স্বাচিপের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, দেশের চিকিৎসকরা সম্মুখসারীর অগ্রজ যোদ্ধা হিসেবে কোভিড-১৯’র বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখনই চিকিৎসকদের যে নির্দেশনা দিয়েছেন দেশের আপামর চিকিৎসক সে নির্দেশনা শিরোধার্য জ্ঞানে যুদ্ধক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু এই কোভিডকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় আমলার চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও কর্মকা- পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকেই বারবার প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। গত সোমবার আকস্মিকভাবে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের কয়েকশ শিক্ষক-চিকিৎসকের গণবদলির আদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর বিরাজিত চিকিৎসাব্যবস্থাকে অস্থিরতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় তাদের খেয়ালখুশি মতো কোভিড চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার নাম করে শ’য়ে শ’য়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করেছে। কিন্তু বদলিকৃত হাসপাতালে এসব বিশেষজ্ঞের কাজ কী হবে, তা নূন্যতম বিবেচনায় নেয়া হয়নি। বেসিক বিষয়ের শিক্ষকতায় যুক্ত চিকিৎসকরা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে কোভিড রোগীদের কী সেবা দেবেন? এসব চিকিৎসক প্রায় প্রতিদিন দিনে এমনকি রাতেও অনলাইনে ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করছেন কলেজগুলোতে, এ বদলি আদেশের ফলে ছাত্ররাও বঞ্চিত হবে শিক্ষকদের ক্লাস থেকে। বেসিক বিষয়ের অধ্যাপনার সঙ্গে যেসব চিকিৎসক সম্পৃক্ত তাদের প্রায় সবাই দীর্ঘসময় ধরে রোগীদের চিকিৎসাসেবা থেকে দূরে, তারা হঠাৎ করে কোভিড রোগীদের কী চিকিৎসাসেবা দেবেন সদর হাসপাতাল বা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে? এ আদেশে বদলির আদেশাধীন চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ ৫০ পেরোনো, এ বয়সের চিকিৎসকদের কোভিড রোগীর চিকিৎসা দিতে বাধ্য করা কতোটা বৈজ্ঞানিক? এ সিদ্ধান্ত কি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সমর্থন করে? তিনি এ আদেশকে তুঘলকি মন্তব্য করে বলেন, এ আদেশে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ, নাক কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন, নিউরোসার্জন, জেনারেল সার্জন, ডেন্টাল সার্জন ইত্যাদি নানা বিশেষায়িত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সদর হাসপাতাল ও উপজেলায় বদলি করা হয়েছে। এসব চিকিৎসকের কোভিড রোগী চিকিৎসার ক্ষেত্র কোথায়? সদ্য বদলিকৃত কোভিড কর্মস্থলে তাদের করণীয়ই বা কী হবে? বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী বলেন, চমেক চট্টগ্রাম বিভাগের উন্নত চিকিৎসার একমাত্র হাসপাতাল। এখানে করোনা ছাড়াও নিয়মিত জটিল রোগ নিয়ে নানা রোগী আসেন। জটিল রোগের অনেক চিকিৎসক এই বদলির তালিকায় রয়েছেন। এতে হাসপাতালের জটিল রোগীরা মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়বেন। যেমন- নিউরোসার্জন, কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের অধ্যাপক, পিসিআর ল্যাব প্রধান, দন্তচিকিৎসকক এ বদলির তালিকায় আছেন। হাসপাতালে বর্তমানে প্রচুর ব্রেইন টিউমারের রোগী আছে। তাদের অপারেশনের কী হবে? তাছাড়া কলেজে সারা বছর যিনি অ্যানাটমি পড়িয়েছেন তাকে দিয়ে তো করোনার চিকিৎসা করানো ঝুঁকিপূর্ণ হবে। আবার দাঁতের ডাক্তার করোনার চিকিৎসায় কী করবেন? সবচেয়ে বড় কথা হাসপাতালের করোনা পরীক্ষার ল্যাব প্রধানকে বদলি করা হয়েছে। এতে করোনা ল্যাবটি অচল হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিএমএ কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় ভৌতিক ও অগ্রহণযোগ্য আদেশ। আমি মনে করি এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বদলি আদেশের বিষয়ে স্বাস্থ্যের দুজন ডিজির কারও সঙ্গে কথা বলা হয়নি। এ ছাড়া একজন মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গেও কথা বলা হয়নি। আমি মনে করি, এ আদেশ যারা দিয়েছেন তাদের মেডিকেল কলেজ সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান নেই। একটি মেডিকেল কলেজ কীভাবে চলে, তার চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন, তা যদি জানতেন তবে তারা এ ধরনের ভৌতিক আদেশ দিতেন না। তিনি আরও বলেন, মৃত চিকিৎসকও তালিকায় আছেন। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, এটি কেমন অপরিকল্পিত আদেশ। মৃত চিকিৎসকের নাম বদলির তালিকায় অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জাকিয়া পারভীন বলেন, বিষয়টি জানা ছিল না। তাছাড়া বড় বদলি আদেশ। হয়তো এজন্য ভুল হয়েছে। অসুবিধে নেই। আমরা সংশোধন করে দেব। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সংযোগ স্থাপন করা যায়নি।