অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ উৎপাদনের ব্যয় পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত। এরই মধ্যে ১০ হাজার ৮৮১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরও ২৯টি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প নির্মাণাধীন।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২৩’-এ নির্মাণাধীন ২৯টি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বহুমুখী জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্প্রসারণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বর্তমানে ১০ হাজার ৮৮১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৯টি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প নির্মাণাধীন। এর মধ্যে আইপিপি খাতের মাধ্যমে ৭৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫টি প্রকল্প এবং ৪ হাজার ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৭টি প্রকল্পের নির্মাণ সরাসরি বাস্তবায়ন করছে বিপিডিবি।’
বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘এই পরিকল্পনায় ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরই মধ্যে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭২৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে।’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকার মধ্যেই আগামী তিন বছরে জাতীয় গ্রিডে আরও ১০ হাজার ৮৮১ মেগাওয়াট যোগ হলে স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক ও বেসরকারি খাত সংশ্লিষ্টদের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের বোঝা আরও বাড়বে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- মোট ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে ৫টি সরকারি খাতে এবং ১৭টি স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদক (আইপি প্রকল্প) হিসেবে বেসরকারি খাতে রয়েছে। বাকি ৭টির মালিকানার কাঠামো স্পষ্ট নয়, যৌথ মালিকানা সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, সমন্বিত গ্রিড ও অফ-গ্রিড (প্রধানত ক্যাপ্টিভ) বিদ্যুৎ ২০২৩ সালে প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বাড়িয়ে নতুন একটি মাইলফলক হিসেবে ৩০ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে পৌঁছে গেছে। যদিও চাহিদা না বাড়ায় এটি সরকারের জন্য বেশি ক্যাপাসিটি চার্জের বাড়তি বোঝা হিসেবে বিবেচিত হবে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
৫ হাজার মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও নতুন স্থাপিত স্থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদনের মাধ্যমে ৩ হাজার ৩৪৩ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে এবং প্রায় ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট অফ-গ্রিড ক্যাপটিভ ও অফ-গ্রিড সৌরবিদ্যুৎ থেকে এসেছে বলে বিপিডিবির তথ্য থেকে জানা গেছে।
এতে আরও দেখা যায়, দেশের গ্রিড-সংযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩ হাজার ৩৪৩ মেগাওয়াট বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বরে ২৫ হাজার ৯৫১ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। এর আগে ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬০৮ মেগাওয়াট।
বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিডের বাইরে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন ১ হাজার ৩৭৯ মেগাওয়াট বেড়ে ২০২৩ সালে ৪ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। ২০২২ সালের এই পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৮১ মেগাওয়াট।
গ্রিডে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা না থাকায় মূলত শিল্প কারখানাগুলো নিজস্ব ব্যবহারের জন্য ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়।
বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দেশে ৪০ শতাংশের বেশি উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও এখনো অনেক শিল্প নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের জন্য তাদের ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পছন্দ করে।
নতুন অফ-গ্রিড ক্যাপটিভ পাওয়ার এবং গ্রিড-সংযুক্ত বিদ্যুৎ একত্রে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০২৩ সালে ৩০ হাজার ৭১১ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে। ২০২২ সালের শেষে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট।
কর্মকর্তারা বলেন, ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি এবং দেশে বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে এক বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াট বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
বিপিডিবি কর্মকর্তারা আরও বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই সক্ষমতা বৃদ্ধি আপাতদৃষ্টিতে উন্নয়ন মনে হলেও ক্রমবর্ধমান উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ক্যাপাসিটি চার্জও বাড়বে। এর ফলে সরকার বিদ্যুৎ না নিলেও আইপিপিগুলো সরকারের কাছ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ পাবে।
তারা বলেন, গ্রিডে যুক্ত হওয়া নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আইপিপি বা স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করেছে- বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনা করে) স্থাপন করেছে। বিপিডিবির তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যাতে তাদের বিনিয়োগ নষ্ট না হয় বা লোকসানে না পড়ে। লোকসানের কারণে তারা বিদ্যুৎ খাত থেকে বেরিয়ে গেলে তা হবে বিপিডিবির দীর্ঘমেয়াদি ভিশনের জন্য বড় ধাক্কা।
দেশে বিরাজমান ডলার সংকট অব্যাহত থাকলে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের ক্রমবর্ধমান বোঝা সরকারের পাশাপাশি ভোক্তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলতে পারে।
ঢাকাভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি পেমেন্ট ২০১৭ সালে ৫ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে আনুমানিক ২৮ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
বিপিডিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তার মতে, ২০২৪ সালে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বিদ্যমান ৪০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ দেশের পিক আওয়ার চাহিদা প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এর ফলে সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ও, অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রয়োজনের তুলনায় উদ্বৃত্ত থাকবে এবং এইভাবে অলস পড়ে থাকবে।
সম্প্রতি সরকারি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নগদ অর্থ, বিশেষ করে মার্কিন ডলার সংকটে পড়েছে। এর ফলে তাদের আমদানি বিল পরিশোধে বড় ধরনের বকেয়া রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ খাতের ক্রমবর্ধমান বকেয়া বিল এখন প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা এবং বাকি ১ বিলিয়ন জ্বালানি খাতে।
এর আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও সংকটের ভয়াবহতা স্বীকার করেছেন।
সম্প্রতি ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আসলে সংকটটা স্থানীয় মুদ্রার নয়। যেভাবেই হোক আমরা ম্যানেজ করতে পারব। তবে মূল সংকট ডলার নিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমরা চাহিদা মতো ডলার পাচ্ছি না।’
—–ইউএনবি
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ