October 3, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, August 31st, 2023, 9:58 pm

অনিয়মের কারণে চরম অর্থ সংকটে বাপেক্স

প্রতীকী ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

অনিয়মের কারণে সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম প্রোডাকশন অ্যান্ড এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি (বাপেক্স) চরম অর্থ সংকটে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য কোম্পানির হাতে পর্যাপ্ত নগদ টাকা নেই। আইন অনুযায়ী গ্যাস বিক্রির ওপর ভ্যাট বাবদ পাওয়া অর্থ ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্যথায় মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা দিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে বাপেক্সকে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে থাকা এফডিআর ভেঙে ওসব অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

এ অবস্থায় সরকারি কোষাগারের পাওনা পরিশোধ, টেকসই অনুসন্ধান, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা এবং বাপেক্সের আর্থিক তারল্য সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে কোম্পানিটি। বিজিডিসিএলসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে সংস্থাটির গ্যাস বিক্রির বিলসহ বকেয়া রয়েছে ১১৪ কোটি টাকা। বাপেক্স সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি মে মাসের ওভারহেড মার্জিন বাবদ ৭ কোটি ১৩ লাখ এবং ভ্যাট বাবদ ৪ কোটি ৯৭ লাখসহ ১২ কোটি টাকার বিল পরিশোধ করছে না। আর গ্যাস বিল যথাসময়ে না পাওয়ায় বাপেক্সে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া অর্থ আইন ২০২০-এর ধারা ৬০ অনুযায়ী প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রির ওপর ভ্যাট বাবদ অর্থ ৯০ দিন অতিক্রমের আগে পরিশোধের আইন থাকা সত্ত্বেও গত বছরের আগস্টের বিল থেকে অদ্যাবধি ভ্যাট বাবদ কোনো অর্থ বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পক্ষ থেকে পরিশোধ হয়নি।

কিন্তু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাপেক্স জরিমানা পরিহারের লক্ষ্যে এফডিআর নগদায়ন করে নিয়মিতভাবে ভ্যাট পরিশোধ করে আসছে। বিগত ২০১৯ সালের জুলাই থেকে বাপেক্সে ভ্যাট বাবদ খুবই কম অর্থ পরিশোধ করছে। যা ভ্যাট আইন পরিপন্থি। এ বিষয়ে বাপেক্স সম্প্রতি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানেরও হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্দেশনা অনুযায়ী বাপেক্স তার উৎপাদিত গ্যাস বিতরণ কোম্পানিকে সরবরাহ করে।

নতুন কূপ খনন ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের জন্য বাপেক্সের পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সময়মতো বিল পরিশোধ না করার কারণে ওই ফান্ড সংকট তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি লোকসানে চললেও বাপেক্স কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বোনাস দিচ্ছে। শ্রীকাইল ৪, তিতাস ১, ২, ৫, ১০ এবং শাহবাজপুর ৪ নম্বর কূপের ওয়ার্কওভার কাজ পরিচালনার জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চারবার বিশেষ বোনাস (মূল বেতনের সমপরিমাণ) দেওয়া হয়। অস্থায়ী শ্রমিকদেরও বিভিন্ন সময় জনপ্রতি ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা বোনাস দেওয়া হয়।

শুধু বিশেষ বোনাস নয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও পানির বিল বাবদও অর্থ নিচ্ছে বাপেক্স থেকে। অভিযোগ আছে, বাপেক্সের একটি সিন্ডিকেট বিশেষ বোনাসের নামে সরকারি অর্থ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। এমনকি ওয়ার্কওভারের (পুরোনো কূপ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ) মতো নিয়মিত কাজের জন্যও এই সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিশেষ বোনাস নিয়েছে।

অথচ কিছুদিন পরপর বলা হচ্ছে, এটি সরকারের একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। সূত্র আরো জানায়, পুরোনো গ্যাসকূপে ওয়ার্কওভারের মূল কাজ করে বাপেক্সের খনন বিভাগের লোকজন। ওই কাজে সহায়তা লাগে প্রকৌশল বিভাগের। এ ছাড়া দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করে আরো অর্ধশত অস্থায়ী শ্রমিক। কিন্তু বিশেষ বোনাস দেওয়া হয়েছে বাপেক্সের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। আর অস্থায়ী শ্রমিকদের হাজিরাও প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছে। একটা পুরোনো কূপে ওয়ার্কওভার কাজ করতে সব মিলিয়ে ৬০-৭০ জনের লোকবল দরকার হয়।

কিন্তু বিশেষ বোনাস দেওয়া হয়েছে ৩৬০ জনের বেশি স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। অভিযোগ আছে, ওয়ার্কওভার কাজের জন্য কোনো কোনো কূপে অস্থায়ী শ্রমিক দেখানো হয়েছে ১০৫-২১৩ জন। তাছাড়া বাপেক্স মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিমাসে ৪০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ২০০ ইউনিট পানির বিল, উপমহাব্যবস্থাপকদের ৩৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ১৫০ ইউনিট পানির বিল, ব্যবস্থাপকদের ৩০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ১০০ ইউনিট পানির বিল, উপব্যবস্থাপকদের ২৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ১০০ ইউনিট পানির বিল, সহকারী ব্যবস্থাপকদের ২৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ১০০ ইউনিট পানির বিল, সহকারী অফিসারদের ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ১০০ ইউনিট পানির বিল এবং অন্যান্য কর্মচারীকে মাসিক ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও মাসিক ১০০ ইউনিট পানির বিল দেওয়া হচ্ছে।

বাপেক্স যে বছর বিশেষ বোনাস ও বাসাবাড়ির পানি-বিদ্যুতের বিল দেওয়া হয়েছে, সেই বছর (২০১৬-১৭) বাপেক্সের নিট লোকসান হয় ২৬৩ কোটি ৩২ লাখ ৯২ হাজার ২৯ টাকা। বিশেষ বোনাস এবং বিদ্যুৎ ও পানির বিলের ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় বলেছে, ওয়ার্কওভার বাপেক্সের নিয়মিত কাজ। এই কাজের জন্য সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্মানি বা বিশেষ বোনাস পেতে পারে না।

এদিকে ওয়ার্কওভার কাজে সবার সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও সবাইকে বিশেষ বোনাস দেওয়ার বিষয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব জানান, যে কোনো অর্জনই কোম্পানির অর্জন হিসাবে ধরা হয়। এজন্য কোম্পানির সবাইকে বিশেষ বোনাস দেওয়া হয়েছে। যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বোনাস দেওয়ার প্রচলন আগে থেকেই আছে।

অন্যদিকে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাপেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা খাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে ১০ কোটি ২০ লাখ ১ হাজার ৯৭৯ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে নিয়েছেন।

বাপেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওই টাকা ফেরত দিতে বলেছে সিএজি কার্যালয়। এ টাকা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালনি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ও। নিরীক্ষাকালে বাপেক্সের বিভিন্ন রেজিস্টার ও ব্যাংক হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করা হয়। চলতি বছর ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।