নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনা মহামারীর তান্ডবে দেশের অর্থনীতিকে গত দুই বছর থেকে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা, রফতানি খাতে মন্দা, প্রবাসী খাতে নিশ্চলতা সব মিলিয়ে বলতে গেলে অর্থনীতি বেশ চাপে পড়েছিল। গতি হারিয়ে ফেলা অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে নানাভাবে। করোনার কারণে গত বছরও দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার গতি কিছুটা শ্লথ ছিল। অন্যদিকে অতিমারীটির নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এর মাঝেও দেশের তৈরি পোশাক খাত, টেক্সটাইল, রেস্টুরেন্ট, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও ওষুধ শিল্পের ব্যবসায় পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অন্যান্য খাতের চেয়ে ত্বরান্বিত হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে সম্প্রতি এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, করোনা অতিমারীর সময়ে বাংলাদেশের শিল্প ও সেবা খাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে ২০২০ সালের জুলাই থেকে সানেম ধারাবাহিকভাবে তিন মাস অন্তর অন্তর এ জরিপ পরিচালনা করছে। এবার সপ্তম পর্যায়ের জরিপে বাংলাদেশের সার্বিক ব্যবসা পরিস্থিতির ওপর জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং ওমিক্রন ঢেউয়ের প্রভাবের বিষয়টিও উঠে এসেছে।
জ¦লানি তেলের দাম দীর্ঘদিন ধরে লাগামছাড়া। জ্বালানি তেলের এই লাগামহীন দাম অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য বহুলাংশে দায়ী। তবে সানেকের জরিপ থেকে জানা যায়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ওমিক্রন সংক্রমণের ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকা-ে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও, সার্বিকভাবে গত বছরের তুলনায় ব্যবসার উন্নতি হয়েছে। কভিডের নতুন ধাক্কার কারণে সামনের তিন মাসের জন্য ব্যবসাগুলোর প্রত্যাশা তুলনামূলক কম। সার্বিকভাবে ব্যবসার পরিবেশে উন্নতি হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় অন্য খাতগুলোর চেয়ে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, রেস্টুরেন্ট, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও ওষুধ শিল্পের ব্যবসায় পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) জন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশা আগের চেয়ে কমেছে।
এটি স্পষ্ট যে, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- ধীরে ধীরে চাঙ্গা হচ্ছে। প্যান্ডেমিক এখন অনেকটা অ্যান্ডেমিকের পথে। উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন যে, কর্মসংস্থানের বন্ধ দুয়ারও খুলতে শুরু করেছে। অধিকাংশ কারখানাতেই নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে থেমে থাকা সরকারী নিয়োগ প্রক্রিয়াও চালু হয়েছে। রফতানিকারকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে নতুন দক্ষ কর্মীরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ বড় কারখানায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর আসছে। শুধু তৈরি পোশাকে ২৫ লাখ শ্রমিক হিসাব করলেও এ খাতে নতুন করে আরও তিন লক্ষাধিক মানুষের কর্মস্থল তৈরি হয়েছে, যদিও এর সুশৃঙ্খল কোন তথ্য নেই। সম্প্রতি মিয়ানমার, চীন ও ভিয়েতনাম থেকে পোশাকের কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়ে আসছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। দীর্ঘদিন পর ইউরোপ-আমেরিকায় অফিস চালু হওয়ায় নিট পোশাকের পাশাপাশি উভেন পণ্যের চাহিদাও বাড়তে শুরু করেছে।
সানেকের জরিপও এমন আভাস পাওয়া যায়। জরিপে ১৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তাদের মতে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার জোরদার হয়েছে। আগের জরিপে এমন প্রতিষ্ঠান ছিল ২১ শতাংশ। অন্যদিকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার মোটামুটি বলে মনে করে ৪৪ শতাংশ। যেটি আগের পর্যায়ে ছিল ৫২ শতাংশ।
সরকারের আয়ের প্রধান উৎস রাজস্ব খাতেও অগ্রগতি এসেছে বলা জানা যায়। গতি বাড়ছে ব্যাংকিং খাতে। এছাড়া করোনায় দেশে বিনিয়োগের যে খরা তৈরি হয়েছিল, তা কাটতে শুরু করেছে। ব্যাংক ব্যবস্থায় ঋণের জন্য আবেদন বাড়ছে। বেড়েছে বিতরণও। ফলে ব্যাংকে যে অতিরিক্ত তারল্য জমে ছিল, তা ছোট হতে শুরু করেছে। করোনার কারণে ২০২১ অর্থবছরের বড় একটা সময় ব্যাংকিং কার্যক্রম ছিল সীমিত। তারপরও আগের বছরের তুলনায় এ খাত থেকে সরকারের আয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণ প্রদান, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ঋণের হিসাব, আমদানি-রফতানিসহ ব্যাংকের সব ধরনের সার্ভিস চার্জ থেকে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট পায়। এ ছাড়া ব্যাংকের কেনাকাটায়ও দিতে হয় উৎসে ভ্যাট। এনবিআরের তথ্য বলছে, ২০২১ অর্থবছরে ব্যাংকের এসব চার্জের ওপর ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ভ্যাট পেয়েছে সরকার। আগের বছর এ খাতে আদায়কৃত ভ্যাট ছিল ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। করোনাকালে ভাল ব্যবসা করেছে ওষুধশিল্প। গত বছর করোনার লকডাউনের মধ্যেও সচল ছিল আবাসনসহ নির্মাণ খাত। এ খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কনস্ট্রাকশন ফার্মগুলো থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। এ খাতের অনুষঙ্গ রড, সিমেন্ট ও সিরামিকস থেকেও রাজস্ব ১০ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। এনবিআরের তথ্যানুসারে, গত বছর স্টিল ও রডশিল্প থেকে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে ২৭ শতাংশ, সিমেন্ট খাত থেকে ১১ শতাংশ ও সিরামিকস থেকে ৩৬ দশমিক ১৬ শতাংশ।
পোশাক খাতও ধীরে ধীরে দুঃসময় কাটিয়ে উঠছে বলে জানা গেছে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তাই সেসব দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য করোনার আগের মতো ক্রয় আদেশ দিচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনাশাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তর করা হচ্ছে। বড়দিন কেন্দ্র করেও প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। তার আগেই চীন থেকে কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে স্থানান্তর করেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, করোনার এই সংকটকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। বিশেষকরে ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ীদের ক্ষতি লক্ষ্যনীয়। এদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। তবে জানা যায়, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজেরে ঋণ পায়নি ৭৪ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। যে ২৩ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রণোদনা পেয়েছে তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ জানিয়েছে প্রণোদনার ঋণ যথেষ্ট নয়। ৬৫ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে আরও সহযোগিতা চেয়েছে বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ