November 8, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, January 22nd, 2022, 9:04 pm

আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা

আত্মহননের পথ বেছে নেয়া শিক্ষার্থীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

জীবন অমূল্য। একটি জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় অসংখ্য জীবন। কাজেই একটি জীবন চলে যাওয়া মানে তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া অসংখ্য জীবনের ক্ষতি। মূল্যবান এই মানবজীবনের অপচয় কোনভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু আমাদের দেশে অহরহ অসংখ্য মূল্যবান জীবন আত্মহত্যায় বিনষ্ট হচ্ছে। দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী পছন্দের শীর্ষে রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আসন নিশ্চিত করতে ভর্তিযুদ্ধে নামতে হয় শিক্ষার্থীদের। দুঃখজনক ব্যাপার হলো এসব আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যাই অধিক। সাম্প্রতিক কিছু জরিপভিত্তিক গবেষণার তথ্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে।
বিদায়ী ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে চার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভয়ংকর এই পথে হেঁটেছেন। এর মধ্যে তিনজনই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। সেপ্টেম্বর মাসে আত্মহত্যা করেছেন আরও তিন শিক্ষার্থীসহ সাতজন। এভাবে গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯ মাসে ১৮০ শিক্ষার্থী আত্মঘাতী হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবার ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকা, বিষণ্ণতা, অবসাদ, পারিবারিক জটিলতা, আর্থিক সংকট, কিছু পাওয়ার জেদ, না পাওয়ার হতাশা, পড়াশোনার চাপ, শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, মানসিক নির্যাতন, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে তারা আত্মহননের পথ বেছে নেন।
আত্মহত্যা নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান জরিপ করে থাকে সময়ে সময়ে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান হলো আঁচল ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুযায়ী, শুধু গত বছরেই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্তত ৫০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ‘করোনাকালে তরুণদের আত্মহত্যাপ্রবণতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান উঠে আসে। গত বছরের পুরো সময়ে অর্ধশতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক এবং অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আরেক গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিলেন। আর ২০১২ সালে এ ধরনের ঘটনা ঘটে মোটে একটি।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ার মূল কারণ হিসেবে অনেক বিশেষজ্ঞই হতাশা, বিষণ্ণতা কিংবা প্রেম জটিলতাকে দায়ী করলেও সূত্র বলছে এসব আত্মহত্যার পেছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও বেশ দায় রয়েছে। সূত্র জানায়, অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরামর্শদান দপ্তরও আত্মহত্যা-সংক্রান্ত কোনো তথ্য সংরক্ষণ করে না। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকা মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও জনবল সংকটে চলছে ঢিমেতালে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষণ্ণতাগ্রস্ত ব্যক্তিকে একা না রাখা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলরসহ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং কোনো একটি অভাব পূরণ না হওয়া মানে জীবন শেষ নয়- এই উপলব্ধিসহ অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে আত্মহত্যা প্রবণতা রোধ করা সম্ভব।
তরুণ এই শিক্ষার্থী তাঁদের জীবনের স্বর্ণালী মুহূর্তে কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে এ নিয়ে দেশের উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষালয়ে কোন ধরণের গবেষণা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, তরুণদের আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করার পেছনে প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করতে পারার মতো কোনো মানসম্পন্ন গবেষণা হচ্ছে না। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত মনোবিদ এবং মনোচিকিৎসক নেই। দেশে প্রায় ৩০০ মনোচিকিৎসক এবং ৫০০ জনের কম মনোবিদ রয়েছেন। সরকারের অবশ্যই পাঠদানের ক্ষতিপূরণ এবং মানসিক সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষার্থীদের সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্ভাবনা হারাতে বসবে।
শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রশান্তির ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশও বড় একটি ফ্যাক্টর। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাপদ্ধতি ও পরিবেশ এমনিতেই শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অনুকূল নয়। করোনাকালীন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রকট হয়ে ওঠা পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো তাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিধ্বংসী প্রবণতার জন্ম দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান পড়াশোনার পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও প্রয়োজনীয় অনেক কিছু এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। সেখানে শিক্ষার্থীরা বুনিয়াদি শিক্ষা লাভ করছে না। একই সঙ্গে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের নামে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশও অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক। সেখানে একজন শিক্ষার্থী বিমর্ষ হয়ে পড়ে।
পরিপ্রেক্ষিতে আত্মহত্যা বাড়ছে ভয়াবহ হারে। সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৪ জুন পর্যন্ত দেশে ১৫১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৭৩ স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী এবং ২৯ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছেন। যদিও এ সংখ্যা ২০১৮ সালে ১১ জন ও ২০১৭ সালে ১৯ জন ছিল। গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে। সব মিলিয়ে গত ১৯ মাসে ১৮০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন বলে তথ্য পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের অন্যতম উচ্চবিদ্যাপীঠেও আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। করোনাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ জন বর্তমান এবং একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। জানা যায়, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করতে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে টেলিফোন নম্বর দেওয়া আছে। ৩০ জন কাউন্সেলর পার্টটাইম এবং একজন স্থায়ীভাবে কাজ করেন। তবে শিক্ষার্থীরা যোগাযোগ করে না। জানতে চাইলেও তারা সাড়া দেয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরই দেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্যনীয়। জানা যায়, গত ১০ বছরে ১১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তার মধ্যে ছয়জন মেয়ে ও পাঁচজন ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্যমতে, ১২ হাজার ৯২১ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন দু’জন সাইকোলজিস্ট ও একজন কাউন্সেলিং অফিসার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও অভিন্ন। গত পাঁচ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ছয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে ৯ জন শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিতে আসে। অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবসাদগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসায় নেই কোনো মানসিক হেলথ কেয়ার সেন্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রায়শ আত্মহত্যার শিকার হচ্ছে।