রেললাইনের বস্তিতে অনিশ্চিত জীবন কাটানো ইউনুস-সাগরিকা দম্পতির এখন পায়ের নিচে একটা শক্ত মাটি হয়েছে। মাত্র এক বছর হলো তার এই পরিবর্তন। এরইমধ্যে যেন নতুন একটি প্রাণ সঞ্চার হয়েছে তাদের মাঝে। একসময়ে অন্যের দোকানে দর্জির কারিগর হয়ে কাজ করা ইউনুছ এখন স্ত্রী সাগরিকাকেও এই দর্জির কাজে যুক্ত করে স্বপ্ন দেখছে ভাগ্য বদলের। সেই স্বপ্ন পূরণে ইতোমধ্যে বেশ এগিয়েও গেছেন তারা।
ইউনুছ মোল্যার বয়স এখন ৩৮। তার স্ত্রী সাগরিকার বয়স ৩০ এর মতো। ১২ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। সংসারে ১০ বছরের একটি ছেলে শাহাদাত ও ৬ বছরের মেয়ে ইয়ানুর। তবে মেয়েটি একেবারেই শারিরীক প্রতিবন্ধী। বিছানাতেই শুয়ে থাকে সারাদিন। বসেও থাকতেও পারে না।
এই হতদরিদ্র ভূমিহীন দম্পতি থাকতো সদর উপজেলার মাচ্চর ইউনিয়নের খলিলপুরের রেলের জায়গায় গড়ে তোলা অন্যের একটি বস্তি ঘরে। ইউনুছ টেইলারের কারিগর ছিল। নিজের কোন সামর্থ্য ছিল না বলে পরের দোকানেই তাকে কাজ করতে হতো। তার বদলে যাওয়া জীবনের সন্ধিক্ষণ হয়ে আসে মুজিব শতবর্ষ।
এই দম্পতির জানায়, এমনভাবে তাদের জীবন বদলে যেতে পারে সেটি তারা ভাবতেও পারেননি। একদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্যার এসে তাদের দেখে যান। এরপর বছরখানেক আগে তারা জানতে পারেন যে, সরকার তাদের দুরাবস্থার কথা জানতে পেরে তাদের একখণ্ড জমিসহ থাকার জন্য একটি পাঁকা ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন।
‘জায়গা ও বাড়ি পাচ্ছি খবিরটি শুনে অবাক হইয়্যা গেছিলাম। পরে যখন সত্যি সত্যি ঘরে উঠলাম, সেইদিন থিক্যাই (থেকে) আমরা দু’জনে কইছিলাম যে, এখন কিছু একটা কইর্যা (করে) জীবনডারেই (জীবনকে) বদলায় ফ্যালাবো।’
এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সাগরিকা জানান, তার স্বামী ইউনুছ মোল্যা অসুস্থ্য ছিল। গ্রামের লোকজনের সাহায্য নিয়ে তার চিকিৎসাও করিয়েছেন ঢাকায় নিয়ে। তখন তারা পরের জায়গায় থাকতেন। নিজেদের ঘরদোর না থাকায় অনেক সমস্যা হতো। পরে যখন সরকার তাদের এই ঘরটা দিল তখন তারা চিন্তা করলেন যে, যেহেতু তার স্বামী অসুস্থ তাই আর বাইরে পরের দোকানে তার কাজ করার দরকার নেই। এরপর থেকেই তারা দুজনে দুটি সেলাই মেশিন জোগাড় করে ঘরেই দর্জির কাজ শুরু করেন।
সাগরিকা বলেন, ‘এহন (এখন) কারিগর থিক্যা (হয়ে) আমার স্বামী টেইলার মাস্টারের কাজ করে। আল্লাহর রহমতে এহন আমাগের (আমাদের) দিন ঘুরতে শুরু করছে। আমাগের আশা আছে আমরা আরো কিছু মেশিন গুছাইয়্যা গ্রামের মেয়েগের টেইলারিং শিখাইয়্যা বড় আকারে টেইলারের দোকান দিবো।’
একেবারেই শূন্য জীবন থেকে নিজের একটি ঘর পেয়ে স্বামী-সংসার নিয়ে গুছিয়ে উঠা এই নারী নিজেকে এখন শুধুমাত্র গৃহিনী থেকে যেনো একজন উদ্যোক্তা হয়ে উঠার স্বপ্ন বুনছেন বুকের ভিতরে।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারতো আমাগে ঘর দিয়্যা সাহায্য করছে। এখন যদি আমাগে এই নিজের পায়ে দাড়াইতে আরেকটু সাহায্য করে তাইলে খুব উপকার হয়। এতে শুধু আমরাই না, গ্রামের আরো কয় পরিবারও খাইয়্যা-পইর্যা বাইচ্যা থাকতে পারবো।’
ইউনুছ-সাগরিকা দম্পতির ছোট্ট মেয়েটি প্রতিবন্ধী হওয়ায় এই ছিন্নমূল পরিবারটিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে তাদের জন্য মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর জমিসহ একটি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জানান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিটন ঢালী।
তিনি বলেন, আমরা তাদের উপরে নজর রাখছি। তারা যদি সামর্থ্য রাখে নিজেদের কর্মসংস্থানের একটি উপায় তৈরির করার, তাহলে সরকার তাদের সবধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। মহিলা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণে এদের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট করা হচ্ছে।
শুধুমাত্র এই ইউনুছ-সাগরিকা দম্পতিই নয়, ফরিদপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘরসহ জমি পাওয়া পরিবারগুলো যাতে একটি নিজস্ব আশ্রয় পাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের কর্মেরও একটি সংস্থান করতে পারেন সেজন্য জোর দেয়া হচ্ছে।
৪৬ বছর বয়সী শারিরীক প্রতিবন্ধী ইদ্রিস আলী এখানে একটি নিরাপদ আশ্রয় লাভের পর এলাকাবাসী তাকে একটি রিকশা কিনে দিয়েছেন। সেই রিকশা চালিয়ে তিনি নিজেই নিজের সংসার চালান। তিনি বলৈন, ‘দিনভর যাই করি, রাইতে ইট্টু মাথা গুজবার ঠাই পাইছি।’
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লাভলী আক্তারের গল্পটা যেনো মরতে মরতে বেঁচে যাওয়ার। অল্প বয়সে বিয়ের পরে পাঁচ মাসের বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায় স্বামী তাকে পরিত্যাগ করে। অল্প বয়সেই নারী হয়ে ওঠা অসহায় মেয়েটির কোলে ছোট্ট এক লামিম (৪) ছেলে ও এক মেয়ে (২) জান্নাত।
লাভলীর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে অপুষ্টি-অনাদরে। পরের বাড়িতে ছাগলের খামারে কাজ করতো। রাতে সেই খামারের ( ছাগল রাখার ঘরে) সন্তান নিয়ে রাত কাটাতো আগে। তিনি বলেন, ‘আমিতো এহন জীবনের নিরাপত্তা পাইছি। ছাওয়াল (ছেলে)-মাইয়্যাডারেও (মেয়ে) স্কুলে পাঠাইতে পারবো। ওগে (তাদের) য্যান আমার মতো পরের বাড়ি কাম (কাজ) কইর্যা (করে) খাইতি না হয়। এই ঘরডা না পাইলে এর কিছুই হইতো না।’ তার মুখে এরপর শোনা যায়, ‘আল্লাহ বঙ্গবন্ধুরে জান্নাতবাসী করুক। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দীর্ঘদিন বাঁচায় রাখুক।’
জানা গেছে, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে ফরিদপুর জেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় তিনটি ধাপে এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৯৯৪ টি ঘর নির্মাণ করে ভূমিহীনদের মাঝে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বাবদ ব্যয় হয়েছে ২১৭ কোটি ৭৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এরমধ্যে জেলার সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি গড়ে তোলা হয়েছে আলফাডাঙ্গার গোপালপুর ইউনিয়নের চরকাতলাসুর গ্রামে ৫৩ একর জমির উপরে। সেখানে ২৮৬টি পরিবারের ঠাই হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় ঘরের পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে মসজিদ, মন্দির, একটি বিদ্যালয়, হাট, খেলার মাঠ, ঈদগাহ মাঠ, কমিউনিটি ক্লিনিক, শিশুপার্ক, ইকো পার্ক ও সামাজিক বনায়ন। উপকারভোগীদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থাও রয়েছে।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগটি যাতে হতদরিদ্র এসব পরিবারের মাঝে বাস্তবিক অর্থেই ফলদায়ক হয়ে উঠে সেজন্য আমরা শুধু তাদের ঘর দিয়েই থেমে থাকিনি। তাদের নিয়মিত খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তারা যাতে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয় সেদিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই এসব ঘরের বসতিদের একটি বড় অংশ এতে বেশ সফলভাবে এগিয়েও যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, আশ্রয়ণের ঘর তোলা এবং বসবাসকারীদের সিলেকশনে অনেক বেগ পেতে হয়েছে, দৈনন্দিন কাজ শেষে সময় পেলে আমি ও আমার সহকর্মীরা দিন-রাতে পরিশ্রম করে। তবে এখন ওদের (আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাসীন্দাদের) হাসিমুখ দেখলে মনটা ভরে যায়। কষ্টটি মনে থাকে না। সরকারি কোন কর্মকর্থা তাদের মাঝে গেলে তারা তাদের নিজেদের পরিবারের লোক মনে করে কাছে ছুটে আসে ।
—ইউএনবি
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি