নিজস্ব প্রতিবেদক :
এলপি গ্যাসের ওপর বাড়ছে দেশের জ্বালানি খাতের নির্ভরতা। প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট, প্রচলিত জ্বালানির দুষ্প্রাপ্যতায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এলপিজি। ইতোমধ্যে শহর ও গ্রামগঞ্জে রান্নার কাজে সিলিন্ডার এলপিজির ব্যবহার বহু গুণ বেড়েছে। গাড়ি ও কলকারখানাতেও ব্যবহৃত হচ্ছে এলপিজি। এককথায় গ্রাহকের সবচেয়ে নাগালে এখন এলপিজি গ্যাস। যদিও চাহিদার ৯৯ শতাংশ এলপিজি আমদানি করা হয়। তারপর দেশের চাহিদা মিটিয়ে এলপিজি বোতলজাত করে রপ্তানিও করছে অনেক কোম্পানি। জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্কট এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ব্যয়বহুল হওয়াতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। আর এই সংকটে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে এলপি। এলপিজি দামেও সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ জ্বালানি। বর্তমানে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখছে এলপিজি। বিগত ১৯৯৯ সালে দেশে এলপি গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয়। এখন দেশে অনুমোদন পাওয়া এলপিজি সরবরাহকারী বেসরকারি কোম্পানি ৫৮টি, এর মধ্যে সক্রিয় ২৯টি। এ ছাড়া এলপিজি কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি সরকারি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, ওমেরা, সেনা, যমুনা, টোটাল, ওরিয়ন, জি-গ্যাস, নাভানাসহ অনেক কোম্পানি বাজারে এলপিজি বিক্রি করছে।
বড় ২০ কোম্পানি এলপিজি কাঁচামাল প্রোপেন ও বিউটেন আমদানি করে নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে বিক্রি করছে বোতলজাত করে। কয়েকটি কোম্পানি এদের থেকে কিনে শুধু বোতলে ভরে এলপিজি বিক্রি করছে। দেশে ১২ থেকে ৪৫ কেজি পর্যন্ত বিভিন্ন পরিমাণে এলপি গ্যাস সিলিন্ডারে বিক্রি হয়। বাসাবাড়িতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ১২ ও ১৫ কেজির সিলিন্ডার, দাম যথাক্রমে ৯৯৯ ও ১২৪৮ টাকা। ৩০-৪৫ কেজির সিলিন্ডার বেশি ব্যবহৃত হয় হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে। ৩০ কেজির দাম ২৪৯৬ টাকা আর ৪৫ কেজির দাম ৩৭৪৪ টাকা।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে এলপিজির বার্ষিক চাহিদা ১৪ লাখ টনেরও বেশি। এই খাতে বিনিয়োগ ৩২ হাজার কোটি টাকা। গ্রাহক প্রায় ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তিন কোটির বেশি মানুষ এ গ্যাসের সুবিধাভোগী। তিন-চারজন সদস্যের একটি পরিবারের ১২ কেজির এক থেকে দেড়টি সিলিন্ডারে মাস চলে যায়। বর্তমানে বছরে এলপিজির মার্কেট ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এলপি গ্যাস দেশের জ্বালানি চাহিদার ৯ শতাংশ পূরণ করছে। গৃহস্থালিতে ৮৪ শতাংশ, শিল্পকারখানায় ১২ শতাংশ ও পরিবহন খাতে ৪ শতাংশ এলপিজি ব্যবহার হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এলপিজির চাহিদা ৩০ লাখ টনে উন্নীত হবে। বাংলাদেশ মূলত কাতার, কুয়েত ও ইরান থেকে এলপিজি আমদানি করে।
সূত্র আরো জানায়, অনেক গাড়ির মালিক এখন কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাসের (সিএনজি) দাম বাড়ায় এলপিজির দিকে ঝুঁকছেন। তেলের চেয়ে এলপিজিতে জ্বালানি খরচ সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। সাধারণভাবে ঢাকা নগরের মধ্যে ১ লিটার বা ১৩০ টাকার অকটেন দিয়ে ১৫০০ সিসির একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ১০-১২ কিলোমিটার যেতে পারে। একই টাকার এলপিজি দিয়ে ১৮-২০ কিলোমিটার যাওয়া সম্ভব। এখন প্রতি লিটার অটোগ্যাসের দাম ৪৬ টাকা ৫৯ পয়সা। সরকার এ খাতের প্রসারে ২০১৭ সালে ১৫ শতাংশ ডিউটি ফি মওকুফ করে। অগ্রিম আয় কর (এআইটি) ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ এবং অগ্রিম কর (এটি) ৩ শতাংশ করা হয়। ২০২১ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করে দেয়। দেশে এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনের ওপর আগের ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে এলপিজির দাম অনেক কমে আসে।
এদিকে দেশের এলপিজি ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে এ শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সঠিক অবকাঠামোর অভাব। কর্ণফুলী নদীতে মাত্রাতিরিক্ত পলি জমার কারণে বড় জাহাজের বদলে ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে এলপিজি টার্মিনালে আনতে হয়, যা আমদানি খরচ বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া এলপিজিভর্তি ছোট জাহাজ যদি দেশের নদীগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে পারতো তাহলে খরচ কমে আসত। তবে নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে কোম্পানিগুলোকে মোংলা, পায়রা বা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রিফাইনারি পর্যন্ত এবং সেখান থেকে দেশের পরিবেশকদের কাছে ট্যাংকারে করে এলপিজি পরিবহন করতে হয়। এতে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে।
তবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের ১৫ কোটি ডলারে ৩০ হাজার টন স্টোরেজ ক্ষমতাসহ একটি রেফ্রিজারেটেড এলপিজি বেস টার্মিনাল নির্মাণাধীন রয়েছে। সেটির কাজ শেষ হলে বড় জাহাজে এলপিজি আনা সম্ভব হবে। তখন দাম কমে আসবে। অন্যদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, এলএনজি ও এলপিজি দুটোই আমদানি করতে হয়। এলপিজির দর জ্বালানি তেলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই এলএনজির চেয়ে এলপিজি আগামীতে সাশ্রয়ী হতে পারে। দেশের যেসব জায়গায় প্রাকৃতিক গ্যাসের নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি, সেখানে রান্নার কাজে, শিল্পকারখানা চালাতে, পরিবহনে এলপিজির বিকল্প নেই। যেহেতু বাসাবাড়িতে প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ আছে, তাই ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোতে এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে। ইদানীং গাড়িতেও এলপিজি ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই দেশের জ্বালানির সংকট মেটাতে আগামীতে এলপিজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমছে। তাই বাসাবাড়িতে নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। রান্নার জন্য এলপিজি এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। এর দাম সহনীয় রাখতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। অনেক কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। আমদানি পর্যায়ে কমানো হয়েছে ভ্যাট-ট্যাক্স। সিলিন্ডার উৎপাদনেও সুবিধা পাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এলপিজি খাতের বিকাশে আগামীতে আরও ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ