নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে ওষুধ বাণিজ্যে সীমাহীন নৈরাজ্যে রোগীরা জিম্মি। দিন দিন নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ এবং ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। কিন্তু ওষুধ বাণিজ্যের নৈরাজ্য রোধে ক্রেতা সচেতনতার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ওষুধে সয়লাব দেশের বাজার। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও কাক্সিক্ষত সুফল পাচ্ছে না। বরং ভেজাল ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে। স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান এবং দেশের বাজারে ৯৭ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ওষুধশিল্প নিজ দেশেই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ওষুধের উপাদান এবং কার্যকারিতা নিয়ে কোনো প্রচার না থাকায় ক্রেতারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন ওষুধের বদলে নিম্নমানের ও নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছে। নিয়ম-নীতির ফাঁক গলে বাজারে ঢুকে পড়ছে নিম্নমানের ভেজাল ওষুধ। রাজধানীর মিটফোর্ডের ওষুধ মার্কেটের একটি চক্রের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মানহীন ওষুধ। আর জাতীয় ওষুধ নীতির বাধ্যবাধকতার কারণে ওষুধ কোম্পানিগুলোও তাদের ওষুধ সম্পর্কে ক্রেতাদের জানাতে পারে না। ফলে কোম্পানিগুলো বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে ডাক্তারদের প্রভাবিত করে ব্যবস্থাপত্রে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখাচ্ছে।
সূত্র জানায়, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দেশের বৃহত্তম পাইকারি ওষুধের বাজার ঢাকার মিটফোর্ডে ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির বিরুদ্ধে মাঝে-মাঝেই অভিযান চালায়। মিটফোর্ডের কিছু প্রতিষ্ঠান এবং সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে সারা দেশে ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ভেজাল ও নকল ওষুধের নেটওয়ার্কে শত শত কোটি টাকার বিপণন হচ্ছে। শুধু জরিমানা ও অপ্রতুল শাস্তি দিয়ে ওই ভেজাল, নকলের দৌরাত্ম্য ঠেকানো যাচ্ছে না। কার্যকর তদারকির অভাবে একই চক্র বারবার সংঘবদ্ধ অপকর্মে জড়িয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্য মতে, বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত ওষুধের দোকানের সংখ্যা ১ লাখ ৫৩ হাজার। তার মধ্যে গত দুই বছরেই প্রায় ৩৫ হাজার নতুন নিবন্ধন পেয়েছে। আর নিবন্ধন ছাড়া দেশে কতগুলো ওষুধের দোকান রয়েছে তার সঠিক কোনো হিসাব অধিদপ্তরের কাছে নেই। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি সংশ্লিষ্টদের মতে, সারা দেশে লাইসেন্সধারী ফার্মেসির প্রায় সমান পরিমাণ লাইসেন্স ছাড়া ওষুধের দোকান রয়েছে। ওই সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি হবে। বহু ফার্মেসি লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর ওসব দোকানের মাধ্যমেই ক্রেতাদের কাছে ভেজাল ওষুধ বিক্রি হয়। রাজধানীসহ সারা দেশের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ওসব দোকান বিস্তৃত।
সূত্র আরো জানায়, সাম্প্রতিক কয়েকটি অভিযানে বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধের চালান ধরা পড়ায় ভেজাল ওষুধ নিয়ে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি সামনে চলে আসে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)গত ৩০ মার্চ দেশের সর্বাধিক সেবন করা দুটি ট্যাবলেটের বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ উদ্ধার করেছে। ঠা-া-শ্বাসকষ্ট আর গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় বহুল প্রচলিত ওই ওষুধ দুটি আটা-ময়দা আর রং ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছিল। তার আগে ১৫ মার্চ চট্টগ্রাম শহরে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির মোড়কে ৩ হাজার ৬৪১ ভেজাল ওষুধ জব্দ করে র্যাব। ওসব ওষুধের মধ্যে এন্টিবায়োটিক, স্টেরয়েডের মতো ওষুধও রয়েছে। মূলত রাজধানীর বৃহত্তম ওষুধের বাজার মিটফোর্ড কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশের মফস্বল শহর ও গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ। ঔষধ প্রশাসনের নজরদারির অভাবে মফস্বলের ক্রেতাদের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। তাছাড়া বাজার প্রচলিত ওষুধগুলোর নকল ও ভেজাল তৈরি করে মফস্বলের ফার্মেসিগুলোতে অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে বলা হয়, ওষুধ এবং স্বাস্থ্য বিষয়াবলির ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের দ্বারা সাধারণ মানুষ যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ওষুধ এবং ওষুধ সম্পর্কিত কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা যাবে না। তাতে লাভবান হচ্ছে এক শ্রেণীর ডাক্তার। কারণ প্রচারের সহজ ব্যবস্থা না থাকলেও ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিপণন ও প্রচারণা খাতের প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা কমিশন হিসাবে বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে এক শ্রেণির ডাক্তারের পকেটে চলে যাচ্ছে। রোগীদের প্রেসক্রিপশনে নিজেদের ওষুধ লিখে দিতে ডাক্তারদের ফ্ল্যাট, বিদেশ ভ্রমণ, ফ্রিজ, টেলিভিশন থেকে শুরু করে নানা আকর্ষণীয় উপঢৌকন দেয় ওষুধ কোম্পানিগুলো। বিনিময়ে ডাক্তাররা সংশ্লিষ্ট ওষুধ কোম্পানির ওষুধ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেয়।
অন্যদিকে স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বাংলাদেশের ওষুধশিল্পে বিস্ময়কর বিকাশ ঘটলেও দুর্বল তদারকির কারণে ওই অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে যেখানে বিদেশি ওষুধের ওপর প্রায় শতভাগ নির্ভরতা ছিল, সেখানে ৫০ বছর পর বিশ্বের ১৪৭ দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ নির্ভরতার দেশ। শুধু সাধারণ নয়, বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এখন ভ্যাকসিন, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ওষুধ, ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করছে। ইতোমধ্যে দেশের অন্তত ১৪টি কোম্পানি বিভিন্ন দেশে নিবন্ধন পেয়েছে। তার মাধ্যমে সেসব দেশে আরো বিপুল পরিমাণ ওষুধ রপ্তানির পথ প্রশস্ত হয়েছে। স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর দখলে দেশের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধের বাজারের ৯৭% শতাংশই। ১৮ কোটি মানুষের এই দেশের পুরো চাহিদা মিটিয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে প্রতি বছর। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও এক শ্রেণির নকলবাজ ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করে সাধারণ মানুষকে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য প্রশাসনের জোরালো নজরদারি না থাকায় বেপরোয়া ভেজালকারীরা বারবার ফিরে আসছে। স্বাস্থ্য প্রশাসনের নজরদারি না বাড়ালে এ অব্যবস্থাপনা থেকে মুক্তি মিলবে না।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ