অনলাইন ডেস্ক :
কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের বলটি ছিল মিডল স্টাম্পে। লিটন কুমার দাস শাফল করে অফ স্টাম্পের বাইরে চলে যান আগেই। পরে লাইন দেখে লেংথ ত্বরিত বুঝে নিয়ে হাঁটু গেড়ে চালিয়ে দেন ব্যাট। ফাইন লেগ দিয়ে ছক্কা। বেশ ঝুঁকিপূর্ণ শট, কিন্তু লিটনের ব্যাটে তা হয়ে ওঠে অনায়াস। গ্লোবাল টি-টোয়েন্টিতে তার প্রথম ম্যাচের প্রথম ওভার সেটি। শুরুটাই কতটা আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর! কিন্তু প্রভাতের সূর্য গোটা দিনের পূর্বাভাস ঠিকঠাক দিতে পারেনি লিটনের ক্ষেত্রে। তার শুরুর ওই দ্যুতি ম্যাচের মিলিয়ে যায় পরের অংশে। টুর্নামেন্টের বাকি সময়টাতেও একটি ম্যাচ ছাড়া তিনি ছিলেন একদমই ম্রিয়মান । সারে জাগুয়ার্সের পুরো আসরে ৮ ম্যাচে ৭ ইনিংস খেলে ২১.৭১ গড়ে লিটনের সংগ্রহ ১৫২ রান। স্ট্রাইক রেট কেবল ১০০.৬৬। বিদেশি টি-টোয়েন্টি লিগে খেলার অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে লিটনের।
২০১৯ সালের ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) খেলেছেন। এ বছর তার পায়ের ছাপ পড়ে ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আইপিএলে। তবে কোনোটিতেই নিজেকে মেলে ধরার পর্যাপ্ত সুযোগ তিনি পাননি। সিপিএলে দুটি ও আইপিএলে একটি ম্যাচ খেলেই থেমেছে তার যাত্রা। সিপিএলে জ্যামাইকাল তালাওয়াহসের হয়ে এক ম্যাচে তার রান ছিল ২১ বলে ২১, আরেকটিতে ২৫ বলে ২১। আইপিএলে অনেক আলোচনা ও কৌতূহলের পর তার অভিষেক হয় গত ২০ এপ্রিল। দিল্লি ক্যাপিটালসের বিপক্ষে দিল্লিতে সেদিন ৪ বলে ৪ রান করে আউট হন তিনি। পরে কিপিংয়েও তার পারফরম্যান্সে ছিল স্নায়ুর চাপে ভোগার ছাপ। আর কোনো ম্যাচে সুযোগ হয়নি তার।
এবার কানাডার গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি লিগে তাকে দলে নেয় সারে। জাতীয় দলের ব্যস্ততা না থাকায় পুরো টুর্নামেন্টের জন্যই তাকে অনাপত্তিপত্র দেয় বিসিবি। কিন্তু এবার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েও ঠিক কাজে লাগাতে পারেননি লিটন। স্রেফ এক ম্যাচে তিনি খেলেন পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংস। বাকি ছয় ইনিংসের কোনোটিতে ২৫ রানও পেরোতে পারেননি ২৮ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। ব্রামটন উলভসের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো ৪৫ বলে ৫৯ রানের ইনিংস ছাড়া লিটনের বলার মতো কোনো ইনিংস নেই। অন্য ম্যাচগুলিতে স্রেফ একবার স্ট্রাইক রেট ছিল একশর বেশি। সেদিন তার ব্যাট থেকে আসে ২০ বলে ২১ রান। অথচ জাতীয় দলের হয়ে এই সংস্করণে দারুণ ছন্দে থাকা অবস্থায় গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি খেলতে গিয়েছিলেন লিটন। চলতি বছর বাংলাদেশের হয়ে ৮টি বিশ ওভারের ম্যাচে ২ ফিফটিসহ ১৪১.৭০ স্ট্রাইক রেটে তিনি করেন ২৮২ রান।
জাতীয় দলের সেই ফর্মকে বয়ে নিতে পারেননি কানাডার টুর্নামেন্টে। আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশটি এখনও ক্রিকেটের অবকাঠামোগত দিক থেকে বেশ পিছিয়ে। ব্রামটনের মাঠের উইকেট ও আউটফিল্ড নিয়েও প্রশ্ন তোলার জায়গা আছে অনেক। প্রায় সব ম্যাচেই খেলা হয়েছে মন্থর ও নিচু বাউন্সের উইকেটে। ফলে ব্যাটসম্যানদের কাজ ছিল বেশ কঠিন। পরিসংখ্যানেও রয়েছে এর প্রমাণ। ২৫ ম্যাচের টুর্নামেন্টে স্রেফ ৪টিতে দেখা গেছে ১৫০ ছোঁয়া ইনিংস। শেষ ভাগে এসে ১২০-১৩০ রান করেও ম্যাচ জিতেছে দলগুলো। এসব ভাবনায় রেখেই লিটনের এবারের কানাডা সফরকে ব্যর্থ মানতে চান না না জাতীয় নির্বাচক হাবিবুল বাশার। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথোপকথনে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক বললেন, পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় লিটনের পারফরম্যান্সে তিনি অখুশী নন। “আমার মনে হয়েছে, লিটন ভালো খেলেছে। উইকেট মন্থর ছিল, বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল।
হয়তো নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারেনি সে। তবে এরকম উইকেট ও কন্ডিশন বিবেচনায় সে ভালো পারফর্ম করেছে। সব মিলিয়ে আমি খুশি।” এই টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স দেখে জাতীয় দলের জন্য লিটনকে নিয়ে দুর্ভাবনার জায়গা দেখেন না হাবিবুল। সামনের এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপে এই ব্যাটসম্যানের কাছে বড় প্রত্যাশাই রাখছেন তিনি। “এই টুর্নামেন্টে কেউই অত বড় রান করেনি। ওই হিসেবে (লিটনের পারফরম্যান্স) ঠিক আছে। ভালো উইকেট পেলে লিটনও বড় রান করতো। এমনিতে ও বড় রান করেই। তাই এই লিগের পারফরম্যান্স নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার কিছু নেই।”
“এশিয়া কাপ কিংবা বিশ্বকাপ, বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন লিটন। ওর কাছে সবসময়ই ভালো শুরুর আশা থাকে। ও ভালো শুরু করলে বাকিদের কাজটা সহজ হয়। লিটনের ওপর প্রত্যাশা সবসময়ই বেশি।” তবে বাস্তবতা বলছে, উইকেট ও কন্ডিশন বিবেচনায় রেখেও কানাডায় লিটনের সামনে ছিল আরও ভালো কিছু করার সুযোগ। কোনো দলের বোলিং আক্রমণ ছিল না খুব ধারাল। দু-একজন ভালো বোলার থাকলেও কোনো দলের বোলিংয়েই ছিল না তেমন কোনো বড় নাম। স্বাগতিক কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সহযোগী দেশগুলির ক্রিকেটার ছিলেন অনেক।
উইকেট-কন্ডিশন বিবেচনায় হয়তো টি-টোয়েন্টিসুলভ বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের সুযোগ তেমন ছিল না। কিন্তু মিরপুরের সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্য থাকা উইকেটে মানিয়ে নিয়ে এবং কিছুটা সময় নিয়ে ইনিংস বড় সুযোগ ছিল প্রায় প্রতি ম্যাচেই। লিটন তা পারেননি। টুর্নামেন্টে অন্তত ১০০ রান করা ২১ জন ব্যাটসম্যানের মধ্যে লিটনের চেয়ে কম স্ট্রাইক রেট স্রেফ একজনের। এই তথ্যেই কিছুটা ফুটে ওঠে, কতটা ধুঁকতে হয়েছে স্টাইলিশ এই ব্যাটসম্যানকে। মন্ট্রিয়ল টাইগার্সের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ৯ রান করতে তিনি খেলেন ১১ বল। পরের ম্যাচে টরন্টো ন্যাশনালসের বিপক্ষে দারুণ দুটি শটে চার ও ছক্কায় ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিলেও থেমে যান ২০ বলে ২১ রানে।
মিসিসগা প্যান্থার্সের বিপক্ষে দল জিতলেও ধীর ব্যাটিংয়ে ৩০ বলে ২৫ রান করেন তিনি। পরের ম্যাচে ১২৯ রান তাড়ায় তার ব্যাট থেকে আসে ৩টি করে চার-ছক্কায় ৫৯ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস। দলের ৬ উইকেটের জয়ে সেদিন তার হাতেই ওঠে ম্যাচ সেরার পুরস্কার। এরপর তিন ম্যাচের কোনোটিতেই একশ স্পর্শ করেনি লিটনের স্ট্রাইক রেট। ফাইনালে রোববার তিনি করেন ১৩ বলে ১২ রান। শেষ ম্যাচেই কেবল তার বিদায়ে ভূমিকা ছিল উইকেটের নিচু বাউন্সের। অন্যগুলিতে কখনও বড় শটের চেষ্টায়, আবার কখনও রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বা জোর করে শট বানানোর চেষ্টায় হারান নিজের উইকেট। সব মিলিয়ে লিটনের ব্যাটের চেনা ঝিলিক দেখাই গেল না কানাডার লিগে। অপেক্ষা এখন সামনের এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের বাংলাদেশের হয়ে তার জ¦লে ওঠার।
আরও পড়ুন
কানপুর টেস্টে মুমিনুলের সেঞ্চুরি, বাংলাদেশের সংগ্রহ ২৩৩ রান
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার বিয়য়ে যা বললেন তামিম
অক্টোবরে বাংলাদেশে সফরে আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা