নিজস্ব প্রতিবেদক :
কারসাজি করে অহরহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে একাধিক অসাধু সিন্ডিকেট। বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও বাস্তব চিত্র উল্টো। বরং অসাধু চক্র চাহিদা বিবেচনা করে পণ্য টার্গেট করে দাম বাড়াচ্ছে। বেআইনিভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে অসাধু চক্র ভোক্তার পকেট থেকে প্রতি বছর হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। আর ভোক্তারা সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে অসহায় হয়ে পড়ছে। কারণ ভোক্তারা বাড়তি দরে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে। নিত্যপণ্য নিয়ে গড়ে উঠা সিন্ডিকেট চাল থেকে শুরু করে ডাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, শাক-সবজি, চিনি, মসলা নিয়ে কারসাজি করছে। এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে অক্সিজেন, ইনজেকশন, কম্পিউটার সামগ্রীসহ মুখরোচক খাবারেও তারা সক্রিয়। নিত্যপণ্যের যখন উৎপাদন কম হয় এবং চাহিদা ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে, তখনও অসাধুরা অহেতুক দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অসাধু সিন্ডিকেটের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম অব্যাহত থাকে। আর ওভাবেই ভোক্তার পকেট কেটে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। বছরের পর বছর এমন অপকর্ম চললেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের রহস্যজনক কারণে একরকম নির্বিকার। তারা লোক দেখাতে মাঠপর্যায়ে কয়েকজনকে নামমাত্র জরিমানা করে দায়সারা গোছের দায়িত্ব সম্পন্ন করে। আর অধরা থেকে যায় সিন্ডিকেটের মূল নায়করা। বিগত ২০১৯ সালে ভারতে পেঁয়াজের উৎপাদন কম হলে অসাধুরা সিন্ডিকেট করে জুলাই থেকে দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়াতে থাকে। আগস্টে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ওই পণ্যটির দাম লাগাম ছাড়া হয়ে ওঠে। আর দাম বাড়তে বাড়তে অক্টোবর পর্যন্ত ৩০ টাকা কেজি পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ৩২০ টাকায় বিক্রি হয়। ওই সময়ে ভোক্তার পকেট থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে কনসাস কনজ্যুমারস সোসাইটির গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, সিন্ডিকেট ভোক্তার পকেট থেকে তখন প্রায় ৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলে এবং জুলাই থেকে আগস্টে চালের দাম বাড়ানো হয়। চলতি বছরে চালের দাম বাড়িয়ে ১৩ মে থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ভোক্তার পকেট থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন চালের পাশাপাশি সিন্ডিকেট সদস্যরা আটার দামও বাড়াতে শুরু করেছে। তাছাড়া করোনাকালে প্রয়োজনীয় ওষুধের চাহিদা বাড়ায় তার দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি শাক-সবজির দামও চড়া।
সূত্র জানায়, রোজার মাসকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই চিনি, ছোলা, শসা, বেগুনের দাম আকাশচুম্বী হয়। আর কোরবানির ঈদ ও শীতে বাড়ে মসলার দাম। এভাবে একটির পর একটি পণ্যকে টার্গেট করে দাম বাড়ানো হয়। আর প্রায় পুরো বছরই সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরেও কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। যদিও পণ্যমূল্য নিয়ে কারা কারসাজি করে তাদের সব তথ্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে রয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেটগুলো প্রভাবশালী হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। বাজার বিশ্লেষকরা আলোচিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার জন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সদিচ্ছার অভাব ও আইনি দুর্বলতাকে দায়ি করছে। তাদের মতে, নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে স্থায়ী নীতিমালা দরকার। আর তা প্রচার করে যেমন সবাইকে জানানো প্রয়োজন, তেমনি ভোক্তা ও বিক্রেতা দু’পক্ষকেই সচেতন করতে হবে। তার ব্যত্যয় ঘটলেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাধিক সংস্থা রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন। কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেলে ওসব প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করে। পরিচালনা করে মোবাইল কোর্ট। তার মাধ্যমে খুচরা বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের সপ্তাহখানেকের জন্য জেল ও জরিমানা করা হয়। তার বাইরে কোনো শাস্তি দেয়া হয় না। তাছাড়া প্রচলিত আইনেও তার বেশি শাস্তি দেয়ার বিধান নেই। যদিও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আলাদা আইন রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- কৃষি বিপণন আইন, নিরাপদ খাদ্য আইন, ওজন ও পরিমাপ মানদ- আইন, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন আইন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ সমৃদ্ধকরণ আইন, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, শিল্প এলাকায় রাসায়নিক পণ্য আইন, পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন।
সূত্র আরো জানায়, পণ্যমূল্য তদারকি করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে ঢাকা শহরে ৩২টি মোবাইল টিম রয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় ৩৭টি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয় এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা মাঠপর্যায়ে তদারকি করে। কিন্তু জনবলের অভাবে সব বাজারে সব সময় তদারকি করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেকেই বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি জরিপ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটি হলে পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন, আমদানি ইত্যাদি তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া সহজ হবে। তাছাড়া বিগত ২০২০ সালে পণ্যমূল্য বাড়লে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) থেকে একটি তদন্ত হয়। দেশের বড় বড় বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে পরিচালিত ওই তদন্তে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে কারা জড়িত তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অসাধু সিন্ডিকেটের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রীও একাধিকবার বলেছেন, পণ্যমূল্য বাড়ানোর নেপথ্যে সিন্ডিকেট জড়িত। অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম বাড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারপরও কোনো সিন্ডিকেট সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যার কারণে ধানের বাম্পার ফলনের পরও চাল বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে মোবাইল কোর্ট ও নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের আইনের আওতায় সামান্য জরিমানা ও হাতেগোনা কয়েকজনের সপ্তাহখানেকের জেল দেয়া হয়েছে।
এদিকে অহরহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জানান, অসাধুরা যে কোনো অজুহাতে ভোক্তার পকেট কাটে। সুযোগ পেলেই সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে অতি মুনাফা করতে চায়। তাছাড়া অনেক সময় পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি থাকলেও পণ্যের দাম বাড়ে। তবে অসাধু পন্থায় দাম বাড়ালেও দৃষ্টান্তমূলক কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় না। যে কারণে অসাধুরা বারবার একই পন্থায় ভোক্তার পকেট কেটে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের এখনই কার্যকর ভূমিকা রাখা জরুরি। অসাধুদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাতে ভোক্তার উপকার হবে। কারণ এখন করোনাকালে সবার আয় কমেছে। সেজন্য নিত্যপণ্যের বেশি ব্যয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাছাড়া যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তা আগেভাগে আমদানি করে রাখলে পণ্য নিয়ে অসাধুরা কারসাজি করতে পারবে না।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (উপ-সচিব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার জানান, অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশে প্রতিদিন বাজার তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলেই সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তাছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙতে মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যেখানেই অনিয়ম পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই ভোক্তা আইনের মধ্যে এনে অভিযুক্তদের শাস্তি ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাতে ভোক্তারা তাদের নিজ অধিকার নিয়ে পণ্য ক্রয় করতে পারে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম