October 4, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, June 2nd, 2022, 8:45 pm

কুলাউড়ায় পুলিশী পাহারায় মন্দিরে প্রবেশ করলেন সেই বিতর্কিত মহারাজ প্রদীপ বিশ্বাস

জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার জয়চন্ডী ইউনিয়নের সিটিএস মন্দিরের গুরু মহারাজ ওরফে প্রদীপ বিশ্বাসের অবস্থান নিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে মন্দিরের দুই মহারাজের আধিপত্যের দ্বন্ধ ও দানের অর্থের আত্মসাতসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে মন্দির থেকে নির্বাসিত ছিলেন গুরু মহারাজ প্রদীপ বিশ্বাস। গত সোমবার (৩০ মে) রাতে পুলিশী প্রহরায় প্রদীপ মন্দিরে অবস্থান নিলে দুই পক্ষের মধ্যে ফের চাপা উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
মন্দিরে যাতে কোন অস্থিতিশীল ও অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে সেজন্য থানার একজন উপ পরিদর্শকের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল সেখানে সার্বক্ষণিক অবস্থান করছে। মন্দিরে বন্ধ রয়েছে পূণ্যার্থী এবং সাধারণ ভক্তদের প্রবেশ ও পূজা অর্চনা। বিষয়টি নিয়ে বিব্রত প্রশাসন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রদীপ বিশ্বাস ভারতের কলকাতার নদিয়া পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা (পাসপোর্ট নং জেড ২৬০৮১৫৮) পেশায় একজন ব্যবসায়ী। ভারত থেকে ব্যবসায়ীক ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। দেশে এসে ধর্মযাজক হিসেবে পরিচিত করতে সিটিএস মন্দিরের গুরু মহারাজ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন প্রদীপ। প্রদীপ বিশ্বাসের সাথে তাঁরই শিষ্য ওই মন্দিরের আরেক মহারাজ দামোদারের বিরোধ চলছিলো। এ ছাড়াও মন্দিরের দানে প্রাপ্ত টাকা পাচারের অভিযোগে দুদকে অভিযোগ করা হয় প্রদীপ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এবং দেবোত্তর সম্পত্তি দখলসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে মন্দিরের গুরু মহারাজ প্রদীপ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা আদালতে চলমান রয়েছে। তাঁর এমন কর্মকান্ডে স্থানীয় সনাতন ধর্মলম্বী ও মন্দিরের ভক্তদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হলে কয়েক মাস ধরেই মন্দির থেকে বাহিরে ছিলেন প্রদীপ বিশ্বাস।
সিটিএস মন্দিরের এমন অরাজক পরিস্থিতিতে গত ৬ এপ্রিল দু’পক্ষের বিরোধ নিষ্পত্তিতে বৈঠকে বসে উপজেলা প্রশাসন। সেই সভায় মন্দিরের আর্থিকসহ পরিচালনার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আহবায়ক ১৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়াও থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা, কুলাউড়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষসহ দুই মহারাজের পক্ষের ৪জন করে সদস্য এই কমিটিতে রাখা হয়। ওই কমিটি পরবর্তীতে মন্দিরের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিরসনসহ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ওই কমিটির সদস্য মন্দিরের গুরু মহারাজ প্রদীপ বিশ্বাস উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে সময় নিয়ে ভারতে চলে যান। সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরে সেই কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মন্দিরের বিভিন্ন বিষয়সহ মন্দিরের অধ্যক্ষ দামোদার মহারাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি বরাবরে। বিষয়টি নিরসনে দায়িত্ব দেওয়া হয় সিলেট রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব বিজয় তালুকদারকে। ২২ মে পুলিশের এই কর্মকর্তা অভিযোগটি তদন্তে স্বাক্ষ্যগ্রহনে দুই পক্ষকে বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে একটি চিঠি দেন। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজির কার্যালয়ে গত ৩০ মে সাক্ষ্য গ্রহণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ওই দিন দুই পক্ষের উপস্থিতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ হয় মৌলভীবাজারে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদর্শন কুমার রায় এই সাক্ষ্যগ্রহণ করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন সিটিএস মন্দিরে আগের মতো অবস্থান করবেন প্রদীপ বিশ্বাস। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় মন্দিরের অধ্যক্ষ দামোদার মহারাজসহ স্থানীয় সনাতন ধর্মালম্বী লোকজনের মধ্যে।

সরেজমিন বুধবার দুপুরে পুষাইনগরের সিটিএস মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরের প্রধান ফটক বন্ধ। ভিতরে থানার এস আই বিপ্রেশ রঞ্জন দাসের নেতৃত্বে পুলিশ পাহারায় রয়েছে। এসময় বিষয়টি নিয়ে গুরু মহারাজ প্রদীপ বিশ্বাসের সাথে কথা বলতে চাইলে তাঁর সেবক জানান, গুরু মহারাজ এখন ভজনে আছেন। এখন কোন কথা বলবেননা।
মন্দিরের অধ্যক্ষ দামোদার মহারাজ বলেন, গত ৬ এপ্রিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে দুই পক্ষের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়। এটা মন্দিরের গুরু মাহারাজও মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি সিলেটের ডিআইজি বরাবরে আবেদন করেন। সোমবার দুই পক্ষের উপস্থিতিতে মৌলভীবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদর্শন কুমার রায় আমাদের দুইজনকে ডেকে নিয়ে জানান গুরু মহারাজ এখন থেকে মন্দিরে থাকবেন এবং আগামী তিনদিনের মধ্যে দুই পক্ষের একটি কমিটি দেওয়ার জন্য বলেছেন।
মৌলভীবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) সুদর্শন কুমার রায় জানান, মন্দিরের চলমান দ্বন্দ্ব নিরসনে ডিআইজি কার্যালয় থেকে তদন্ত আসলে আমরা উভয় পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসি। বৈঠকের সিদ্ধান্ত উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছে। মন্দিরের দুই মহারাজ যাতে সম্মিলিতভাবে তাদের ভক্তদের নিয়ে মন্দির পরিচালনা করেন সেই বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে উপজেলা প্রশাসনের গঠিত ১৩ সদস্যে কমিটির মধ্যে দুই পক্ষের ১০ জনের স্বাক্ষ্যগ্রহণ নেওয়া হয়। মন্দিরের আর্থিক স্বচ্ছতা ও মন্দির পরিচালনার জন্য কমিটিতে কারা থাকবে সেই সকল ব্যক্তিদের নামের তালিকা আগামী শনিবারের মধ্যে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মন্দিরকে ঘিরে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোন অবনতি না হয় সেদিকে প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী জানান, মন্দিরকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ৬ এপ্রিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয় পুলিশ বিভাগ, গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও বিবদমান দু’পক্ষকে নিয়ে বসে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ও মন্দিরের অচলাবস্থা নিরসনের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। মন্দিরের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক থাকে সে ব্যাপারে আমরা দৃষ্টি রাখছি।

সিলেট রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব বিজয় তালুকদার (ক্রাইম) জানান, অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদর্শন কুমার রায়কে দায়িত্ব দেই বিষয়টি দুই পক্ষকে নিয়ে বসে সমঝোতার ভিত্তিতে নিরসনের জন্য। সিদ্ধান্তের বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে। দুই মহারাজের দ্বন্দ নিরসন করে মন্দিরের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি।