জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার :
গত কয়েকদিনের প্রবল বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় হাকালুকি হাওরসহ ফানাই, গোগালী নদীতে বন্যার পানি হু হু করে দিন দিন বেড়েই চলছে। এতে কুলাউড়া পৌর শহরসহ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ৬৬টি গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এদিকে মনু নদীর বানি ক্রমশই বাড়ছে। মনু নদীতে ভাঙ্গন দিলে পুরো কুলাউড়া উপজেলা প্লাবিত হবে। এই আতংক কাজ করছে কুলাউড়ার মানুষের মাঝে। এতে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা ইতোমধ্যে ৩৩ টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছেন। পানিবন্দি লোকজন গবাদিপশুসহ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই নিচ্ছেন। বন্যার পানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ায় উপজেলার ৪৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ ভবনের নিচতলায় পানি প্রবেশ করায় দাপ্তরিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বেশ কয়েকটি কার্যালয়ের।
সরেজমিনে উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, হাকালুকি হাওর তীরবর্তী উপজেলার কাদিপুর-ভূকশিমইল-বরমচাল আঞ্চলিক সড়ক, পুষাইনগর-নবাবগঞ্জ সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে দুই থেকে তিন ফুট পানি। এসব এলাকার বেশিরভাগ বাড়িতে পানি ঢুকে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মানুষ। শনিবার সন্ধ্যা থেকে ঘরের ভিতর পানি প্রবেশ করায় অনেকেই বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ও অন্যত্র আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে নিজেদের একমাত্র সম্বল গরু-ছাগল, হাঁস-মোরগ নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন নিরাপদ স্থানে। রোববার বিকেল পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক মানুষ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
উপজেলার কর্মধা, রাউৎগাঁও ও ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত ফানাই নদী ও জয়চন্ডী, কুলাউড়া সদর, পৌরসভা দিয়ে প্রবাহিত গোগালী নদীতে পাহাড়ি ঢলে নদী উপচে পানি কৃষি জমি এবং হাজার হাজার মানুষের বাড়ি প্লাবিত হয়ে গেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ফানাই নদীর কর্মধার মহিষমারা এলাকায় বাঁধ ভেঙে প্রায় ৫টি গ্রামের ফসলী জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। শনিবার পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় লোকজন বাঁধ মেরামত করলে রাতে আবার পানির ¯্রােতে বাঁধ ভেঙে ফের প্লাবিত হয় এলাকাগুলো। বন্যার পানিতে উপজেলার সাড়ে তিন হাজার হেক্টর ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি রয়েছে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ।
এদিকে প্রবল বৃষ্টিতে শনিবার দুপুর থেকে পৌর শহরের ১, ৩ ও ৪ নং ওয়ার্ডের বাসাবাড়ি ও উপজেলা পরিষদের ভবনের নিচতলায় পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলা সড়কে প্রায় তিন ফুট পানি রয়েছে। রোববার বিকেল পর্যন্ত পানি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। পৌর এলাকার ১০ সহ¯্রাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়, এলজিইডি কার্যালয় এবং কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কার্যালয়ের সামনে পানি প্রবেশ করায় দাপ্তরিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
উপজেলার ৬৬টি গ্রামের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন। এসব এলাকার সবকটি গ্রামীণ রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার ৩৯ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং দুটি কলেজে পাঠদান বন্ধ রয়েছে পানি প্রবেশ করায়। বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে উপজেলা প্রশাসন ৮ ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। রেসকিউ টিম পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ২ শতাধিক পরিবার ও গবাদি পশু আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে কর্মকর্তারা বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ও পানি বন্দি এলাকা পরিদর্শন করছেন। পানিবন্দি মানুষকে ত্রাণ সহায়তা প্রদানের জন্য ইয়াকুব তাজুল মহিলা ডিগ্রি কলেজ, রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভূকশিমইল ইউনিয়নের ভৈরবগঞ্জ বাজার, ভূকশিমইল স্কুল এন্ড কলেজ বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র, মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় তিন শতাধিক মানুষের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া হাকালুকি হাওর তীরের সাদিপুর, ভূকশিমইল, ঘাটেরবাজার এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পান্দিবন্দি মানুষের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেন ইউএনও এটিএম ফরহাদ চৌধুরী। এসময় প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাসহ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। পৌর শহরের ইয়াকুব তাজুল মহিলা কলেজে পানি ওঠে যাওয়ায় কলেজের পাঠদান, দাপ্তরিক কার্যক্রম ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম ফিলাপ ব্যাহত হচ্ছে। পৌর শহরের রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিচতলায় পানি প্রবেশ করেছে। দুই ও তিন তলায় আশ্রয় কেন্দ্র মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
সরেজমিন হাকালুকি হাওর তীরের কাইরচক, চিলারকান্দি, জাবদা, কানেহাত, কালেশার, কাদিপুরের আমতৈল, পৌরশহরের রাবেয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে বিদ্যালয়ের নিচতলায় হাঁটুপানি উঠেছে। বিশেষ করে ভূকশিমইলের কাইরচকসহ প্রায় ১৩টি বিদ্যালয় সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে। এদিকে পৌর শহরের রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভূকশিমইলের ভৈরবগঞ্জ বাজার শেড ঘর, ভূকশিমইল স্কুল এন্ড কলেজ বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র, চিলারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে পানিবন্দি মানুষ আশ্রয় নিচ্ছেন। ভূকশিমইল স্কুল এন্ড কলেজ বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রের নিচতলায় প্রায় ৩০-৩৫টি গবাদিপশুরও ঠাঁই হয়েছে।
ভৈরবগঞ্জ বাজার শেড ঘর আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা সাদিপুর গ্রামের রিকশা চালক সালাম মিয়ার স্ত্রী শিপ্পি বেগম বলেন, সাদিপুর এলাকার হাওর তীরে আমার ঘর ছিল। কিন্তু হঠাৎ হাওরে পানি বাড়ায় আমরা দুই দিন থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছি। একই গ্রামের বদল মিয়ার স্ত্রী বকুল বিবি (৬২) বলেন, বন্যার পানিতে আমার বাড়িতে কোমর পানি। ৪ ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে এখন আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছি। সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা পেয়েছি।
ভূকশিমইল স্কুল এন্ড কলেজ বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা আকমল হোসেন (৬৩) বলেন, আমি দিনমজুর মানুষ। পাঁকার কাজে রান্না করে দিয়ে কোনমতে সংসার চালাই। হঠাৎ বন্যার পানি বাড়ায় এই আশ্রয় কেন্দ্রে ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ে নিয়ে উঠেছি। সাথে আমার ৩টি গবাদিপশুও এই আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে এসেছি। একই সাথে মিনা বেগম (৩৬) বলেন, ছোট্ট দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটে এসেছি। সাথে দুটি গরু নিয়ে এসেছি। এগুলোই আমাদের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম। আশ্রয় কেন্দ্র থাকায় আমাদের সাথে গৃহপালিত গবাদিপশুরও ঠাঁই হয়েছে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা পেয়েছি।
ইয়াকুব তাজুল মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এমদাদুল ইসলাম ভুট্টো বলেন, আমার কলেজে হাঁটু পানি ওঠে যাওয়ায় অফিসের দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিকল্প হিসেবে আমার বাসায় করা হচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম ফিলাপ কার্যক্রমসহ অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ। কলেজের ২য় ও ৩য় তলায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পানি কমলে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ইফতেখায়ের হোসেন ভুঞাঁ বলেন, উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় রোববার পর্যন্ত ৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। পানি বাড়লে আরো ঝুঁকিপূর্ণ অনেক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হতে পারে। অনেক বিদ্যালয়ের দুই তলায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আমাদের কার্যালয়ে শনিবার থেকে পানি ঢুকে যাওয়ায় অন্যত্র অস্থায়ীভাবে দাপ্তরিক কার্যক্রম চালাচ্ছি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আনোয়ার বলেন, উপজেলার ১০ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, কুলাউড়ায় পানিবন্দি মানুষের জন্য ৩৫ মেট্রিক টন ত্রাণ সহায়তা বরাদ্দ পেয়েছি। ইতোমধ্যে এক হাজার পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ শুকনো খাবার কার্যক্রম চলমান আছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ দল প্রস্তুত রয়েছে। প্রশাসনের লোক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রসহ পানিবন্দি এলাকার মানুষকে ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দিচ্ছি। যেসব এলাকায় বেশি পানি সেখানে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা এড়াতে ওই সব কিছু এলাকায় বিদ্যু সরবরাহ সাময়িক বন্ধ রাখতে কুলাউড়া বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে নির্দেশ দিয়েছি। বন্যা আশঙ্কায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসক স্যার মীর নাহিদ আহসানের নির্দেশনায় আমরা তৎপর রয়েছি।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি