October 5, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, December 3rd, 2021, 7:56 pm

গর্ভের সন্তানসহ নিজেকে মেরে ফেলতে অনুরোধ মায়ের!

অনলাইন ডেস্ক :

হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সময় কাঁদছিলেন একজন নারী। মা হতে চলেছেন তিনি। তাকে ও তার সন্তানকে মেরে ফেলার জন্য চিকিৎসককে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন। আফগানিস্তানের এই মা চরম অপুষ্টির শিকার। তাঁর বুকে সন্তানকে খাওয়ানোর মতো দুধ নেই। তিলে তিলে মরার চেয়ে সন্তানসহ একবারেই মরে যেতে চেয়েছিলেন এই মা। এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন আফগানিস্তানের হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ নুরি (ছদ্মনাম)। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দুর্বল ওই মায়ের সন্তানের জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। এই মায়ের মতো হাসপাতালটিতে আরও অনেক মা রয়েছেন। বিবিসিকে চিকিৎসক নুরি জানিয়েছেন আফগানিস্তানের হাসপাতালগুলোর দুরবস্থার কথা। নুরি বলেন, হাসপাতালে প্রসববেদনায় কাতর মায়েদের ভিড় বাড়ছেই। ভিড় এত বেশি যে চিকিৎসকদের হাঁটার মতো জায়গা থাকে না। হাসপাতালের পরিবেশও নোংরা। নুরি বলেন, বেতন ছাড়া কাজ করতে হয় বলে কয়েক মাস আগে বেশির ভাগ পরিচ্ছন্নতাকর্মী হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছেন। মায়েদের আর্তনাদের শব্দ এখন হাসপাতালজুড়ে। হাসপাতালের মেঝেটাও রক্তে ভেজা। মায়েদের ওয়ার্ডে এত বেশি রোগী যে অনেক সময় কয়েকজন মায়ের জন্য কেবল একটি বিছানা বরাদ্দ থাকে। হাসপাতালের কাছের ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে আগের সময়ের তুলনায় রোগী এখন তিন গুণ বেশি। যেকোনো হাসপাতালে মায়েদের ওয়ার্ডকে সবচেয়ে আনন্দের জায়গা বলে মনে হয় চিকিৎসক নুরির। কিন্তু সেটিই এখন কান্না আর হাহাকারে ভরা। নুরি বলেন, গত সেপ্টেম্বরে মাত্র দুই সপ্তাহে অপুষ্টির কারণে পাঁচ নবজাতক মারা গেছে। হাসপাতালটি যেন নরকে পরিণত হয়েছে। নুরির মতো আফগানিস্তানের বিভিন্ন হাসপাতালে কোনো বেতন ছাড়াই কাজ করছেন অনেক চিকিৎসক। বিবিসির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছেন কয়েকজন চিকিৎসক। তাদের বয়ানে উঠে এসেছে হাসপাতালগুলোর ভয়ানক পরিস্থিতির কথা। কয়েক দশক ধরে চলা সংঘর্ষ আর খরায় বিপর্যস্ত আফগানিস্তান। তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থাতেও ধস নেমেছে। আন্তর্জাতিক সহায়তার কারণে গত কয়েক দশকে দেশটির অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। গত আগস্ট থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে আসায় দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন আবার মুখ থুবড়ে পড়েছে। আফগানিস্তানের দুই হাজার তিন শর বেশি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। প্রত্যন্ত এলাকার চিকিৎসকদের কাছে ওষুধ নেই। সাধারণ অসুখবিসুখে প্যারাসিটামলের মতো ওষুধ জোগাড় করতেও তাদের ১২ ঘণ্টার বেশি হাঁটতে হয়। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের অন্যতম বড় শিশু হাসপাতালে অপুষ্টির শিকার শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতালের ধারণক্ষমতার ১৫০ শতাংশ বেশি রোগী রয়েছে সেখানে। হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক সিদ্দিকি জানান, সেপ্টেম্বর মাসে ১০ বছরের নিচের বয়সী চারজন শিশু প্রতি সপ্তাহে অপুষ্টি বা অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগে মারা গেছে। তাদের অনেকে আবার খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারা গেছে। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা অপুষ্টির কারণে বেশি ভুগছে এবং তাদের মৃত্যু হচ্ছে। অনেক শিশু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেই মারা যাচ্ছে। এ ধরনের অনেক শিশুকে আমরা ঝরে যেতে দেখছি।’ হাসপাতালগুলো খাদ্য ও ওষুধের সংকটে রয়েছে। রোগীদের একটু ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। হাসপাতালে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র কাজ করছে না। হাসপাতালের কর্মীরা গাছের ডাল কেটে, শুকিয়ে তাতে আগুন জ¦ালিয়ে হাসপাতাল উত্তপ্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হাসপাতালের কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গাছের কাঠ শেষ হয়ে গেলে আগামী মাসে কী করবেন, তা ভেবে তাঁরা উদ্বিগ্ন। একই অভিমত চিকিৎসক নুরিরও। মায়েদের ওয়ার্ডে নিয়মিত বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে প্রায়ই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ইনকিউবেটরগুলোতে বিদ্যুৎ-সংযোগ না থাকার কারণে অনেক অপরিণত শিশু মারাও যাচ্ছে। নুরি বলেন, ‘এটা খুব দুঃখের যে আমাদের চোখের সামনে শিশুরা মারা যাচ্ছে।’ অস্ত্রোপচারের সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে মৃত্যুর ঘটনা বেশি বাড়ছে বলেও জানান নুরি। অস্ত্রোপচারের সময় বিদ্যুৎ চলে গেছে, এমন একটি ঘটনার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে নুরি বলেন, ‘আমরা অস্ত্রোপচার করছিলাম। এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। সবকিছু বন্ধ করে দিতে হলো। আমি দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম। সাহায্যের জন্য চিৎকার করলাম। এ সময় কেউ একজন তাঁর গাড়ির জ¦ালানি আমাদের অস্ত্রোপচার কক্ষের জেনারেটর চালুর জন্য ধার দিলেন। বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে, এ ভয়ে অনেকে হাসপাতালে খুব দ্রুত অস্ত্রোপচার করতে চান।’ এটাও একটা বাড়তি চাপ বলে জানান নুরি। এ ধরনের চাপের মধ্যে কাজ করার পরও অনেক স্বাস্থ্যকর্মী সময়মতো বেতন পান না বলেও জানান নুরি। হেরাত প্রদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয় করোনা রোগীদের। ওই হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক রাহমানি তালেবানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে আসা একটি চিঠি বিবিসিকে দেন। ওই চিঠিতে তারিখ ছিল ৩০ অক্টোবর। সেখানে আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তহবিল নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বেতন ছাড়া কাজ করতে কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার চিকিৎসক রাহমানি জানান, তহবিল বরাদ্দ না হওয়ায় আর্থিক সংকটের কারণে তারা হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। রোগীদের স্ট্রেচারে করে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ছবি বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। তাদের এখন কী হবে, তা জানা নেই। ওই হাসপাতালের কাছাকাছি আরেকটি হাসপাতালে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানেও রোগীরা সংকটে রয়েছেন। রোগীদের হেরোইন, ক্রিস্টাল মেথ, আফিম দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। তবে সে জন্য বিকল্প যেসব ওষুধ রোগীদের দিতে হয়, তার সংকট রয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক নওরোজ বলেন, যারা মাদকাসক্ত, তাদের অস্থিরতা কমাতে বিছানার সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়েছে। অথবা তাদের হাতকড়া পরিয়ে বিছানার সঙ্গে রাখা হয়েছে। এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসা করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতাল এ ধরনেররোগীদের জন্য কারাগারের মতোই।’ আর্থিক সংকট ও কর্মীদের বেতন দিতে না পারার কারণে এই হাসপাতালও বন্ধ হওয়ার পথে। চিকিৎসক নওরোজ বলেন, যদি হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে আসছে শীতে এই রোগীদের অবস্থা কী হবে, তা নিয়ে তারা চিন্তায় রয়েছেন। চিকিৎসক নওরোজ আরও বলেন, এ ধরনের রোগীদের কোনো আশ্রয় নেই। তারা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সেতুর নিচে, ধ্বংসস্তূপে, কবরস্থানে কষ্টকর অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হবেন। তালেবানদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী চিকিৎসক কালান্দার ইবাদ গত নভেম্বরে বিবিসি পার্সিকে বলেন, সহায়তাগুলো আবার ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আফগান সরকার কাজ করছে। আফগানিস্তানে শীতের কারণে হাসপাতালের রোগীরা কষ্ট পাচ্ছে। চিকিৎসক নুরি বলেন, শিগগিরই তারা সুপেয় জলের সংকটে পড়তে পারেন। এ ছাড়া পাকিস্তান ও ভারত থেকে যে পথে পণ্য আসে, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তা আনা কঠিন হতে পারে।চিকিৎসক নুরি আরও বলেন, ‘যখন সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর মায়েরা তাদের কোলে নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে যান, তখন আমি ভাবি, এরপর তারা কী করবেন। কারণ, এই মায়েদের কাছে খাবার কেনার মতো অর্থ থাকে না।’ নুরি ও তার পরিবারও কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছে। নুরি জানান, চিকিৎসক হিসেবে তার যতটা খাবার খাওয়া প্রয়োজন, ততটা তিনি খেতে পারছেন না। কারণ, তার কাছে জমানো টাকা প্রায় শেষের পথে। চিকিৎসক নুরি বলেন, ‘আমি জানি না, কেন এখনো আমি কাজ করতে আসি। প্রতিদিন সকালে আমি নিজেকে এ প্রশ্ন করি। উত্তরটা হলো, হয়তো এখনো আমি ভালো কোনো ভবিষ্যতের প্রত্যাশা করি।’ তবে কবে সেই সুদিন আসবে, তা জানেন না নুরির মতো আফগানিস্তানের অনেক চিকিৎসক।