নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চুলা জ্বলে না। কোনও এলাকায় দুপুর ছাড়িয়ে রাতও হয়। এলপিজি ব্যবহার করছেন যারা তাদের চিন্তা না থাকলেও মাসে চলে যাচ্ছে অন্তত দুই হাজার টাকা। সঙ্গে গ্যাস বিলও দিতে হচ্ছে। তবে এসব যাদের দেখার কথা, সেই এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কর্তাদের কাজ যেন দাম বাড়ানো পর্যন্তই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসের ঘাটতির কথা বললে পেট্রোবাংলার তরফ থেকে বলা হয় অনেক গ্যাস চুরি হচ্ছে। আমরা এলএনজি আনতে পারছি না। কিন্তু যে বৈধ গ্রাহকের সঙ্গে পেট্রোবাংলা এবং বিতরণ কোম্পানি চুক্তি করেছে তিনি কেন কোম্পানির ব্যর্থতার দায় নেবেন, সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর মিলছে না। এদিকে বাসা-বাড়ির পাশাপাশি দেশের শিল্প-কারখানাগুলোতে তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। শিল্প মালিকদের অভিযোগ, সংকট সমাধান চেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বারবার ধরনা দিলেও কোনো সমাধান মিলছে না। কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে সক্ষমতার মাত্র ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এমন বাস্তবতায় কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছেন অনেক শিল্প মালিক। জানা গেছে, বর্তমানে দিনে গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ২৩০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি থাকে প্রায় ১৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। তিন বছর আগে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরুর মধ্য দিয়ে গ্যাস-সংকট সমাধানে বড় ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। এলএনজি আমদানিতে সরকার দীর্ঘ মেয়াদে দুটি চুক্তিও করেছিল। এরপর আমদানির চাহিদা বাড়লেও নতুন করে দীর্ঘ মেয়াদে চুক্তি করতে পারেনি সরকার। বাড়তি চাহিদা মেটাতে শুরু হয় খোলাবাজার (স্পটমার্কেট) থেকে এলএনজি কেনা। এদিকে দীর্ঘ মেয়াদে নতুন করে চুক্তি করতে না পারার খেসারত দিতে হচ্ছে গত বছর থেকে। কারণ, এরইমধ্যে খোলাবাজারে এলএনজির দাম গত বছর পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। গত বছর আমদানি করা এলএনজির ২০ শতাংশ এসেছে খোলাবাজার থেকে। এ বছর আসবে আমদানির প্রায় অর্ধেক। এ বছর দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানির লক্ষ্যমাত্রা আছে পেট্রোবাংলার। এর জন্য এলএনজি বহনকারী ১০৩টি কার্গো আমদানি করতে হবে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে পাওয়া যাবে ৫৬টি। বাকি ৪৭টি কিনতে হবে খোলাবাজার থেকে। এদিকে আগামী দুই বছরে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বাড়তি থাকার পূর্বাভাস রয়েছে। তাই চড়া দামেই আমদানি হবে এলএনজি। এর ফলে সরকারের ভর্তুকি বাড়বে। যার ফলশ্রুতিতে গ্রাহক পর্যায়ে বাড়বে গ্যাসের দাম। এদিকে বিদেশে থেকে এলএনজি আমদানির পর টার্মিনালে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তা প্রাকৃতিক গ্যাসে রূপান্তর করা হয়। এরপর সেখান থেকে গ্যাসের জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। জানা গেছে, দেশে এখন মহেশখালীর গভীর সমুদ্রবন্দরে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল আছে। এর একটি টার্মিনাল চালাচ্ছে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি ও অন্যটি দেশীয় কোম্পানি সামিট। দুটি টার্মিনাল দিয়ে দিনে ৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা আছে এখন। এর মধ্যে গত বছর নভেম্বরে সামিটের টার্মিনালের মুরিং লাইন ছিঁড়ে যায়। ফলে সে সময় এলএনজিবাহী কার্গো ভিড়তে পারেনি। এদিকে দেশের পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন শিল্পে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস আমদানি বাড়ানোর নতুন অবকাঠামো নির্মাণে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। নতুন টার্মিনাল নির্মাণের কাজেও তেমন গতি নেই। দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা এলাকার গভীর সমুদ্রে আরও একটি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণে গত বছর পৃথক প্রস্তাব দিয়েছে এক্সিলারেট এনার্জি ও সামিট। এসব প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করছে জ¦ালানি বিভাগ। এ ছাড়া গত ৩০ সেপ্টেম্বর মাতারবাড়ী এলাকায় স্থলভাগে একটি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে সামিট। এর আগে গত বছর আরও ১৫টি বিদেশি কোম্পানি মাতারবাড়ীতে টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে সরকারের কাছে। ইতোমধ্যে আগ্রহীদের মধ্য থেকে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়েছে। কিন্তু ওই দুটি এলাকার কোনোটিতেই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা যায়নি। পেট্রোবাংলা বলছে, লক্ষ্যমাত্রার পুরোটা আমদানি হলেও ৫৫ কোটি ঘনফুটের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। মাঝে আমদানি কমায় ঘাটতি বেড়ে ৭০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে সিএনজি স্টেশন দিনে চার ঘণ্টা করে বন্ধ রাখা হচ্ছে। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে আছে গ্যাসের অভাবে। শিল্পেও যথাযথ গ্যাস না পাওয়ার অভিযোগ আছে। আগামী দুই বছরে ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার চারটি এলএনজি বিদ্যুৎ উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। এসব কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের এখনো কোনো চুক্তি হয়নি। তাই আমদানি কমে গেলে দেশে গ্যাস সরবরাহের সংকট বেড়ে যাবে। অন্যদিকে চড়া দামে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে সরকারের ভর্তুকি বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই এলএনজি খাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। ভর্তুকির চাপ কমাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম শতভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব জমা পড়েছে বিইআরসির কাছে। এটি যাচাই-বাছাই করে দেখছে বিইআরসি। চলতি মাসেই গ্যাসের দাম বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজস্ব সক্ষমতা না বাড়িয়ে কেবল এলএনজি আমদানি করে গ্যাস সংকট কাটানো যাবে না। এ বিষয়ে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেন, যেসব উৎপাদন আটকে আছে, নতুনভাবে উৎপাদন শুরু করতে চাচ্ছে সেগুলোকে দ্রুত উৎপাদনে নিয়ে আসতে হবে। এ কাজটা করতে সদিচ্ছা ও সাহস দরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রশাসনে এ দুটোরই অভাব লক্ষ্য করা যায়।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি