October 14, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, August 29th, 2023, 9:42 pm

চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ খাচ্ছে ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা-ইজিবাইক

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

একটি এলাকায় বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে তার অর্ধেকই টেনে নিচ্ছে ব্যাটারি চালিত গাড়ী চার্জ দেয়ার মাধ্যমে। ফলে আবাসিক এলাকায় গ্রাহকরা বিদ্যুত ঠিক মত পাচ্ছেনা। জেলা শহরগুলোতে বিদ্যুৎ চুরির অন্যতম প্রধান কারণ নিষিদ্ধ ইজিবাইক বা অটোরিকশা দেশের বিভিন্ন যায়গায় দেখা যায়, যানবাহনের ব্যাটারি চার্জের অধিকাংশ গ্যারেজে রয়েছে বিদ্যুতের বৈধ সংযোগ। এসব গ্যারেজে ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার জন্য জামানত নিয়ে বসানো হচ্ছে ট্রান্সফরমার, আছে অবৈধ সংযোগও। আবাসিকের সংযোগে চলছে চার্জের বাণিজ্যিক কাজ। যে এলাকায় মানুষের ঘনত্ব বেশি বা মানুষ বেশি বসবাস করে সেসব এলাকায় ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সার পরিমানও বেশি।

রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, ধানমন্ডি, খিলক্ষেত, মুগদা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, আদাবর, চটবাড়ি বেড়িবাঁধ, কামরাঙ্গীরচর ও ডেমরায় এসসব অটোরিক্সা বা ব্যাটারি চালিত গাড়ীর চলাচল বেশি দেখা যায়। এছাড়াও যাত্রাবাড়ী, গোড়ান, খিলক্ষেত, মান্ডা, সায়েদাবাদ, সবুজবাগ, খিলগাঁও, চিটাগাং রোড, শনির আখড়ায় রাস্তার পাশেই কয়েক হাজার গ্যারেজ থেকে অবৈধ বৈদ্যুতিক লাইন থেকে এসব ইলেকট্রিক রিকশার ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হচ্ছে প্রকাশ্যেই। শুধু রাজধানী ও এর আশপাশেই এ ধরনের ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা কমপক্ষে ৩ লাখ। এসব যানবাহন চার্জ দিতে দৈনিক প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়।

সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে ৫ থেকে ৬ ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা ধরে ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশায় প্রতিদিন সাড়ে ৩ কোটি টাকার বেশি বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। ২০২১ সালে হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছিলো ইজিবাইক বন্ধে। সেখানে ইজিবাইকের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৪০ লাখ। বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি।

ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চলতে লাগে অনেক বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের এই অভাবের দিনে প্রাত্যহিক জীবনের অনেক কিছুই ত্যাগ করছে দেশের মানুষ। অথচ বিদ্যুৎ খেকো ইজিবাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের কথা কেউ চিন্তা করছে না। যদিও যদিও ইজিবাইক চালানো এবং যন্ত্রাংশ আমদানিতে হাইকোর্টের রয়েছে কড়া নির্দেশনা। আদালত সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর একটি রিটের শুনানি শেষে ব্যাটারি চালিত থ্রি-হুইলার, ইজিবাইক বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেইসঙ্গে এ ধরণের গাড়ি আমদানি, ক্রয় ও বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

২০২১ সালে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত টাস্কফোর্সের ৩য় সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো সড়ক-মহাসড়কের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব প্যাডেল চালিত রিকশা ও ভ্যানে ব্যাটারি বা মোটরযন্ত্র লাগানো হয়েছে শুধুমাত্র সেসব রিকশা ও ভ্যান থেকে ব্যাটারি বা মোটরযন্ত্র খুলে ফেলা হবে। কিন্তু বাস্ততে তার কোন ফল পাওয়া যায়নি। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ইজিবাইক আমদানি ও সরবরাহকারী ব্যবসায়ী সমিতির দেওয়া তথ্যানুযায়ী বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে প্রায় ১৫ লাখের বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান চলাচল।

বর্তমানে বেশ কিছু যায়গা ঘুরে দেখা যায়, নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশায় রাজধানীতে এখন চলাচলের জো নেই। অলিতে গলিতে ইজিবাইক। মহল্লার প্রবেশদ্বারগুলো ইজিবাইকে ঠাঁসা। স্থানীয় সরকারদলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, রাজনীতিক, শ্রমিক নেতা, ছাত্র নেতা বখরা নিয়ে এসব ইজিবাইক চলাচলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। এতে পথচারিরা বিরক্তবোধ করলেও তাদের কিছু যায় আসে না। নগরীর শ্যামপুর, কদমতলী ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় হাজার হাজার ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা পরিচালনার নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় নেতা ও প্রভাবশালীরা। তারা রাতের বেলায় বিদ্যুতের চোরাই লাইন টেনে ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছেন।

ঢাকার ধামরাইতে ছেয়ে গেছে তিন চাকার এই যানবাহনে। ধামরাই পৌরসভাসহ পুরো ধামরাই উপজেলার প্রতিটি অলিগলি এমনকি গ্রাম অঞ্চলেও ব্যাটারি চালিত অটোরিকশায় ছয়লাব। শত খোঁজেও পায়ে চালিত রিকশা পাওয়া যাবে না। দিনে বা রাতে প্রায় ৭/৮ ঘন্টা লাগে একেকটি অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ হতে। ফলে শত শত ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংকটের এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এদিকে সাটুরিয়া উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, সব মিলিয়ে উপজেলায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা তিন সহস্রাধিক। উপজেলায় এসব যানের সংখ্যা পাঁচ হাজার ধরলে, দিনে এসব যান বিদ্যুৎ গিলছে ৭০ হাজার ইউনিট।

অথচ উপজেলায় বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা ১৩ থেকে ১৪ মেগাওয়াট। গড়ে প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে এসব যানবাহনের পেছনে। মানিকগঞ্জের ঘিওরের অলিগলি থেকে শুরু করে সাত ইউনিয়নের সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, অটোভ্যান ও ইজিবাইক। প্রায় তিন হাজারের বেশি ব্যাটারি চালিত গাড়ী চলছে এসব এলাকায়। বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একদিকে যেমন অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে তেমনি অন্যদিকে বিপুল পরিমান বিদ্যুৎ ব্যাটারি চালিত গাড়ী চার্যে চলে যাচ্ছে। এতে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ফলে ভোগান্তীতে পড়ছে এলাকার মানুষ জন। এটা যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘাঁ হয়ে দাড়িয়েছে।

এসব অটোরিক্সা ও ব্যাটারি চালিত তিন চাকার গাড়ীগুলোর ব্রেক সিস্টেম ভালো না থাকায় প্রায় সময়ই কোন না কোন দুর্ঘটনা ঘটছেই। অটোরিক্সা মালিকদের সাথে কথা বললে তারা জানান, সড়কে গাড়ি বেশি হওয়ায় আয় কমে গেছে। বেশির ভাগ লোকই এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ১ থেকে ২ লক্ষাধিক টাকায় এসব যানবাহন কেনেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর এক কর্মকর্তা জানান, ইঞ্জিনচালিত নয় বলে এসব যানকে সড়কে চলাচলের নিবন্ধন দেওয়া হয় না। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ এসব যানবাহনে চার্জ দেওয়ার জন্য আলাদা ট্যারিফ নির্ধারণ করে সংযোগ দিচ্ছে। দিনে সমস্যা কম হলেও রাতে এসব যানবাহন চার্জে বসান মালিক ও চালকরা। তখনই অন্য গ্রাহকদের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা যায় না।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র থেকে জানা গেছে, পায়রা বন্দর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে অব্যাহত রয়েছে বিদ্যুৎ চুরি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা শুষে নিচ্ছে অনেক বিদ্যুৎ। মফস্বল এলাকা বিশেষত গ্রামীন জনপদে এখন লাখ লাখ বিদ্যুৎ চালিত অটোরিকশা, ত্রি-হুইলার বা অটোরিকশা চলছে। রাস্তার দু’পাশে গ্রামীণ বাড়িগুলোতে রয়েছে ত্রিহুইলারের গ্যারেজ। এগুলোতে রাত-দিন ব্যাটারি চার্জ চলছে। রাতে সংযোগ দেয়া হয় অবৈধ বিদ্যুতের। চুরি করা এই বিদ্যুতের বিপরীতে সরকার কোনো রাজস্ব পায় না। ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।