July 27, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, May 16th, 2024, 8:23 pm

চীন সফরে পুতিন, পরীক্ষার মুখে ‘নো লিমিট’ বন্ধুত্ব

অনলাইন ডেস্ক :

বেইজিং সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার এই সফরে দুই দেশের মধ্যকার ‘নো লিমিট’ বন্ধুত্বের সম্পর্ক পরীক্ষায় পড়বে। কারণ, ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধকে সমন্বিত ইউরোপের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে দেখছে মস্কো। এই লড়াইয়ে চীনকে পাশে চায় তারা। চীনও এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের নিন্দা জানায়নি। তবে পশ্চিমাদের অনুকরণে কোনো নিষেধাজ্ঞাও জারি করেনি। আবার পশ্চিমাদের, বিশেষ করে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চায় বেইজিং। পশ্চিমারা চায় ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করতে মস্কোর ওপর যেনও চাপ দেয় বেইজিং। ফলে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে কঠিন পরিস্থিতিতে রয়েছেন চীনা প্রেসিডেন্ট।

ক্রমাগত পশ্চিমা চাপ দুই দেশের এই সম্পর্কে পরীক্ষায় ফেলছে। দুই বছর আগেই ‘নো লিমিট’ সম্পর্কের ঘোষণা দিয়ে তারা বলেছিলেন, আমাদের সম্পর্কের কোনো সীমা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব রুখে দিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার প্রতি চীনা সমর্থন ও ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের সমর্থন কমাতে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপে আছেন শি। তাই কঠিন সময় পার করছেন তিনি। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুতিনের অনড় অবস্থান ইউরোপ থেকে রাশিয়াকে আরও বিচ্ছিন্ন করতে পারে। ইউরোপের একটি প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হলো বেইজিং।

পশ্চিমাদের সঙ্গে ভাবমূর্তি উন্নত করতে চায় চীন। মন্থর অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে রপ্তানি কার্যক্রম বজায় রাখতে চায় দেশটি। সাংহাইভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ শেন ডিংলি বলেন, রাশিয়াকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখে চীন। পুতিনকে যথাযথ সম্মান দিতে চায় দেশটি। তবে অর্থনৈতিক কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায় চীনা সরকার। এটি একটি কঠিন কাজ। শি রাশিয়ার জন্য কতটা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত তা হয়ত পরখ করে দেখতে চাইবেন পুতিন। এছাড়া, পশ্চিমা দেশগুলোকে ইউক্রেনকে সমর্থন করা থেকে বিরত করার চেষ্টা করছেন তিনি।

গত সপ্তাহে ফ্রান্সে শি যখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে বৈঠক করেন তখন পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়ার নির্দেশ দেন পুতিন। যুদ্ধক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে রাশিয়া-এর পক্ষে এই মহড়াটিকে সবচেয়ে স্পষ্ট সতর্কতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছেন শি। বিচ্ছিন্ন অর্থনীতি ও ইউক্রেন যুদ্ধ জারি রাখতে শি’র সমর্থন চান পুতিন। এর জন্য সম্ভবত শি’কে চাপ দেবেন তিনি। পঞ্চমবারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন পুতিন। যদি এই মেয়াদ পূর্ণ করেন তবে শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি রুশ শাসক হবেন তিনি। কিছু দিন আগে ইউরোপ সফর করেন শি। ওই সফরে রাশিয়াপন্থি সার্বিয়া, হাঙ্গেরি ও ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন তিনি। তবে তখন বাণিজ্য বা ইউক্রেন সম্পর্কে কোনো কিছু না বলেই চলে আসেন।

পুতিনের সঙ্গে ৪০ বারের বেশি দেখা করেছেন শি। যা অন্য যেকোনও নেতার চেয়ে বেশি। দুজন প্রায়ই জন্মদিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং একে অপরকে পুরনো প্রিয় বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন। ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একে অপরকে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখতে চান পুতিন-শি। যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কমাতে একটি বিকল্প বৈশ্বিক ব্যবস্থা উপস্থাপন করতে আলোচনা করছেন তারা। ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের চায়না প্রোগ্রামের পরিচালক ইউন সান বলেছেন, এই আলোচনার লক্ষ্য হলো, চীন ও রাশিয়া একে অপরের পাশে কতটা ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছে তা প্রদর্শন করা। তবে রাশিয়ার সঙ্গে এই সংহতি প্রকাশ করলে,পশ্চিমা চাপের শিকার হবে চীন।

যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ না করলেও, রাশিয়ার তেলের শীর্ষ ক্রেতা চীন। পাশাপাশি স্যাটেলাইট বুদ্ধিমত্তা, ফাইটার জেট যন্ত্রাংশ, মাইক্রোচিপ ও অন্যান্য দ্বৈত-ব্যবহারের সরঞ্জাম সরবরাহ করে ক্রেমলিনের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সহায়তা করছে দেশটি। এদিকে, যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য বেশ কয়েকটি চীনা কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। রুশ সংস্থার সঙ্গে ব্যবসা করছে এমন চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেও নিষেধাজ্ঞার তালিকাভুক্ত করার হুমকি দিয়েছে দেশটি। যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে পুতিনকে কোনো পরামর্শ দেননি শি। তবে যুদ্ধ বন্ধের প্রয়োজন অনুভব করতে পারেন তিনি। এদিকে, পশ্চিমাদের সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে চীন। এটি চীনের কৌশলগত অবস্থান।

চীনের এই অবস্থানকে কেউ কেউ কৌশলগতভাবে ‘দুই নৌকায় পা রাখা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেকে ধারণা করছেন, এই কৌশল ফলপ্রসূ হতেও পারে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক তলানিতে নেমে এসেছিল। এখন কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। শি’র সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস প্রধান ইউরোপীয় নেতারাও। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক ইভান এস মেডিইরোস বলেছেন, শি’র এই অবস্থান দেশের ভেতরে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রের গতিকে রাশিয়ার পক্ষে দেখছেন চীনা প-িত ও বিশ্লেষকরা তিনি আরও বলেন, কৌশল হিসেবে ‘দুই নৌকায় পা রাখা’ কল্পনার চেয়ে ভালো কাজ করছে। এর জন্য খুব বেশি করতে হয়নি। রাশিয়াকে শি’র প্রয়োজন।

পূর্ব চীন সাগরে সামরিক মহড়া বাড়িয়েছে চীন ও রাশিয়া। এর মাধ্যমে তাইওয়ানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এই স্ব-শাসিত দ্বীপটিকে নিজের এলাকা বলে দাবি করে চীন। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্কের বিষয়ে বেইজিংভিত্তিক বিশেষজ্ঞ জিয়াও বিন বলেছেন, যদি চীন-রাশিয়া সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ না হয়, চীনকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা নাও করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তাই এটিকে একটি সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখতে হবে। চীনের ওপর পুতিনের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে ঝুঁকির পথে হাঁটছেন পুতিন। যা অতীতে রুশ কর্মকর্তাদের অস্বস্তিকর করে তুলেছিল। ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে চীন রাশিয়ার জন্য প্রাণসঞ্চারি হয়ে উঠেছে।

রাশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে স্থানচ্যুত করেছে চীন। এদিকে, নিজের স্বার্থের পেছনে ছুটছেন পুতিন। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সহানুভূতির সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন তিনি। যার ফলে রাশিয়াকে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করছে দেশটি। এর ফলে চীনের ওপর উভয় দেশের নির্ভরশীলতা কমতে পারে। তবে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে রাশিয়ার সামনে খুব কম বিকল্পই আছে। জ¦ালানি বিক্রি, কম্পিউটার চিপ সরবরাহ ও বিদেশি লেনদেনের জন্য মুদ্রা সরবরাহ করতে চীনকে রাশিয়ার প্রয়োজন।

কার্নেগি এন্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর গবেষক নাথানিয়েল শের-এ পর্যালোচনা অনুসারে, গত বছর রুশ অস্ত্র উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্রের প্রায় ৮৯ শতাংশ চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে সামরিক সরঞ্জাম তৈরির যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে অপটিক্যাল ডিভাইস, ইলেকট্রনিক সেন্সর ও টেলিকমিউনিকেশন গিয়ার সবকিছুই রয়েছে। কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের পরিচালক এবং চীন-রাশিয়া সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার গাবুয়েভ বলেছেন, এটি অনেক বেশি টিকে থাকার পরিস্থিতি। আপনি একটি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আছেন। চীনের কাছে শর্তারোপ করা এখন পুতিনের জন্য বিলাসিতা। সেই সুযোগ এখন আর তার নেই। সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস