October 7, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, July 9th, 2021, 12:50 am

জামিন পাবে না, রিমান্ডেও যেতে হবে… এটা বিচার নয়

লেখক : ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন

মইনুল হোসেন :

আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা নির্দয়। এমনটি হওয়ার বিবিধ কারণ রয়েছে। হাজার হাজার বিচারাধীন বন্দী মাসের পর মাস বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে, কারণ পুলিশ এফআইআর দিয়ে জামিন অস্বীকার করা হয়েছে। আইন বলছে, তার মুক্ত থাকার মৌলিক অধিকার আছে, যেহেতু তাকে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দোষী বলা যাবে না। তবুও গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে সাজাপ্রাপ্ত আসামির মতো কারাবন্দী করে রাখা হয় পুলিশি বিচারের নামে। এফআইআর হচ্ছে প্রাথমিক তথ্য, প্রমাণ নয়। তবুও একজন নির্দোষ লোক কোর্টের আদেশে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এ জন্য আমাদের বিচারব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত জজ-বিচারকরা বিচলিত বোধ করছেন তা বলছি না। মনে হচ্ছে, আমরা অনেকেই অভ্যাসের দাসত্বে ভুগছি।

পুলিশের প্রধান দায়িত্ব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, নিরপরাধ লোক দিয়ে জেল ভরা নয়। তারা গ্রেফতার করলেই কেউ জেল খাটার মতো দোষী হয়ে যায় না।

বিচারব্যবস্থাকে মানবিক করে তোলার দায়িত্ব বিচারকদের। এ জন্য স্বাধীন বিচারব্যবস্থার দাবি করে যাচ্ছি। স্বাধীনভাবে কিছু না করার জন্য নয়। ন্যায়বিচার সম্পর্কে পুলিশের ধারণার সাথে আইন ও মানবিক বিচারের সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

আমরা যদি আইনজীবী হিসেবে, বিচারক হিসেবে আমাদের বিবেকের প্রতি সৎ থাকি তাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার তার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আমরা বিচারের নিষ্ঠুরতা গ্রহণ করতে পারি না।

বলা অসত্য হবে না যে, আমাদের দুই ধরনের বিচার ব্যবস্থা আছে, যার একটি হচ্ছে পুলিশের বিচারব্যবস্থা, যেখানে পুলিশ প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (ঋওজ) পাঠিয়ে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে কারাভোগের সাজা নিশ্চিত করে।

বিচারের অপর ব্যবস্থাটি হচ্ছে বিচারিক ব্যবস্থা যেখানে একজনকে কারাভোগ করার, এমনকি মৃত্যদণ্ড ভোগ করার সাজা দেয়া হয়, যদি বিচারে এফআইআরে বর্ণিত অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণে দোষী সাব্যস্ত হয়।

দোষ প্রমাণের আগে জেল খাটা এবং দোষ প্রমাণের পরে জেল খাটা এ দুইয়ের মধ্যকার পার্থক্য অবশ্যই বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি তো শাস্তি ভোগ করেই যাচ্ছে।

সরকারের অসহনশীলতা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার অবশ্যই অন্যতম দোষ। প্রাথমিকভাবে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে বিচারকদের নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। যারা দলীয় আনুগত্যের বাইরে, তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়।

অন্য দিকে পুলিশ প্রশাসনে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। তাদেরকে অনেক বেশি রাজনৈতিক চাপ মোকাবেলা করে কাজ করতে দেখে যে কেউ দুঃখবোধ করবেন। বস্তুত, জনগণের কর্মচারী হয়েও তারা জনগণের নন। ব্যবস্থাটি দুর্বহ বোঝা হয়ে জনগণের উপর চেপে বসেছে।

সবকিছুর পরও বিচারব্যবস্থা পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করেনি। কিছু স্বাধীনচেতা বিচারপতি এখনো আশার বাতি প্রজ্জলিত রেখেছেন। কিন্তু নেতৃত্ব পাচ্ছেন না।

বিচার শুরু হওয়ার আগেই নিষ্ঠুরতা শুরু হয়ে যায়। তাই অবিচারের উৎস হচ্ছে বিচারে বিলম্ব। পুলিশ মনে করে, বিচার শুরু হওয়ার আগেই গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে যা কিছু করার তা সেরে নিতে হবে। জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবেই, আসামিকে রিমান্ডে নেয়া হবে এবং আসামি তাদের হাতেই থাকবে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য।

আমদের ভালো বিচারক এবং ভালো পুলিশ অফিসার যারা আছেন তারা এখনো আমাদেরকে এই আশা জুগিয়ে যাচ্ছেন যে, বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ পদানত হয়নি। তথাপি জনসাধারণের অসহায়ত্ব বেড়েই চলেছে এবং ভোগান্তি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

সাজাপ্রাপ্তদের তুলনায় অনেক বেশি নিরপরাধ মানুষ জেলে আছে। রাজনীতি যত নিষ্ঠুর হতে চায় হোক, কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তিকে কোর্টে সোপর্দ করা হবে তখন বিচারিক মানবিকতা দেখাতে হবে।

আমরা সবাই জানি সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রেফতার করে লোকদের জেলে পাঠানো। সরকারের বিচারে আগ্রহ নেই। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের জেলে রাখতে পারলেই হলো। সে জন্য বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারে তাদের কোনো তাড়া নেই। বরং সরকার মজা করে বলবে, তারা কাউকে জেলে পাঠায়নি এবং আইন তার নিজের গতিতে চলছে। দোষের দায় বহন করতে হচ্ছে জজ-বিচারকদের।

সরকার পক্ষের উকিলরা তো তাদের সর্বশক্তি দিয়ে জামিনের বিরোধিতা করবেন, নতুবা তাদের চাকরি চলে যাওয়ার ভয় থাকবে। এ জন্য সরকারি উকিলদের রাষ্ট্রের উকিল হওয়া দরকার, যাতে তারা সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এ ব্যাপারে একটি আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছিল; কিন্তু তা বিবেচনায় নেয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।

সরকারি আইনজীবীরা রাষ্ট্রীয় আইনজীবী হিসেবে নিজেদের নিরপেক্ষতা রক্ষা করবেন। সরকারের পরিবর্তন হলেও তাদের পরিবর্তন হবে না। দুঃখের কথা, আইনজীবীরাও বিচারব্যবস্থায় শক্তি জোগাতে পারছেন না। বিচারব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে ভাবছেন না। মনে হচ্ছে আমরা সবাই মাথাহীন, বিবেকহীন হয়ে বেঁচে থাকাটাই যথেষ্ট মনে করছি।

বিনা বিচারে আটক রাখার একটা আইন আছে আমাদের। কিন্তু সরকার তা ব্যবহার করছে না। তারা দেখছে কোর্টে মামলা দিয়ে সব রাজনীতিককে অপরাধী হিসেবে কলঙ্কিত করাই সুবিধাজনক। আমরা চাই কোর্টকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হোক। তারা তাদের রাজনীতি যেভাবে পারেন চালিয়ে যান। বিচারব্যবস্থাকে অসহায় মানুষের সুবিচার পাওয়ার আশা হিসেবে টিকে থাকতে হবে।

আমরা সাধারণ মানুষের জীবনকে অতি সাধারণভাবে গ্রহণ করে থাকি। বড় বড় অপরাধ আইন ও বিচারব্যবস্থার ঊর্র্ধ্বে থাকার বিষয়টি আমরা না জানার ভান করি। আদৌ যদি বড় অপরাধগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করা যেত তাহলেও কী আমরা নিশ্চিত হতে পারতাম যে, কার অপরাধে কে শাস্তি ভোগ করছে। সম্পূর্ণ শাসনব্যবস্থাই চলছে অসততা ও দুর্নীতির ওপর। ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া যায়; কিন্তু দুর্নীতিকারীর দুর্নীতি ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই।

সবার ক্ষেত্রে একই বিচারিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার আগে যারা সাধারণ মানুষ, যারা অসহায় তারা দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে জেলে রাখার নিষ্ঠুরতা থেকে রক্ষা করুন। তা ছাড়া এমন তো হতে পারে, জেলে আটক গরিব লোকটি ছিল তার পরিবারের একমাত্র আয়কারী। জেলে আটক রাখায় তার পরিবারের সদস্যদের অনাহারে থাকতে হবে। জেলে পুরার সহজ পন্থা হিসেবে মামলা রুজু করা আইন প্রয়োগকারী হিসেবে পুলিশকে নির্দয়-নির্মম হলে চলবে না।

আমরা জানি, বিচারিক ব্যবস্থাকে মানবিক করার জন্য বিচারকরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন; কিন্তু সংখ্যায় তারা খুবই কম। তারা সরকারি চাপের মধ্যে আছেন। বুঝতে হবে, গোটা বিশে^র বিচারব্যবস্থা কোনো-না-কোনো ধরনের চাপের মধ্যে আছে। এ পরিস্থিতিতে বিচারব্যবস্থা রক্ষায় আমরা যে দয়া-মায়া, বিবেকবর্জিত নই তা প্রমাণ করতে হবে।

সরকার অন্যসব প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে যা করতে পারে করুণ কিন্তু যতদিন বিচারব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকছে ততদিন জজ-বিচারকদের মানবিক হতেই হবে।

অপরাধের ঊর্র্ধ্বগতি দেখেও তো আমরা বলতে পারছি না যে, লোকদের জেলে আটক রাখলেই অপরাধ কমে যাবে না। অপরাধীর অপরাধ প্রমাণে ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।

দোষ প্রমাণের আগে একজন ব্যক্তিকে নির্দোষ হিসেবে দেখা সার্বজনীন বিচারিক নীতি। তদুপরি আমাদের মৌলিক অধিকার রয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা ভোগ করার। যদি তা আইন দ্বারা খর্ব করা না করা হয়। পুলিশ প্রদত্ত প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বা এফআইআরের ভিত্তিতে জামিন অস্বীকার করার কোনো আইন নেই। বিষয়টি একমাত্র কোর্টের ইচ্ছাধীন। ব্যতিক্রমধর্মী পরিস্থিতি, অপরাধের ধরন, সমাজের নিরাপত্তা হুমকি ইত্যাদি বিষয় বিচক্ষণতার সাথে বিবেচনা করে বিচারক জামিন আবেদন নামঞ্জুর করতে পারেন। পুলিশ তথ্য দিলেই জেল, এটা বিচারের কথা হতে পারে না।

মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারি ব্যর্থতার কারণে কোর্ট কাউকে বিনা বিচারে জেলে পুরতে পারে না। সরকার এ ব্যাপারে গভীর তাগিদ অনুভব করলে দ্রুত বিচারের বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারে। হাজার হাজার তরুণকে মাদক সংক্রান্ত অপরাধে জেলে পাঠাচ্ছে। ভাবা হচ্ছে না কেমন করে মাদক ব্যবসায় বেড়েই চলছে। একইভাবে নারী ও শিশু আইনের অপব্যবহার করছে পুলিশ। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা না করে জেলে বন্দী রাখার নামই আমাদের দেশের বিচার হতে পারে না। পুলিশি ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে। পুলিশ আইনের পুলিশ থাকতে পারছে না। তারা দুর্নীতির পুলিশ হয়ে যাচ্ছে।

জামিন মঞ্জুর করার অর্থ একজনকে কোর্টের হেফাজতে রাখা। সে পূর্ণ স্বাধীন নয়। তাকে জামিনের শর্ত মেনে চলতে হবে। পুলিশের জানা উচিত, জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা কোর্টের ইচ্ছাধীন এবং জামিন পাওয়া অভিযুক্তের অধিকার। মামলাটা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পুলিশকে বলা দরকার। ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারকে অবজ্ঞা করা কোনো সহজ ব্যবস্থা হতে পারে না।

একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ রিমান্ডে দেয়া হবে কেন? নিজের দোষ প্রমাণ করার জন্য পুলিশ তাকে বাধ্য করতে পারে না। যদি রিমান্ডে নিতে হয় তাহলে জজ কেন বলবেন না যে, তাকে তার আইনজীবীর উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট তো তাই বলেছে। আইনের সাহায্য পাওয়া তো শাসনতন্ত্র ও সুবিচারের কথা।

গত মঙ্গলবারের পত্রপত্রিকায় খবর রয়েছে, রিমান্ডে নিয়ে এক মেয়েকে থানার ওসি ও ইন্সপেক্টর মিলে ধর্ষণ করেছে। সব খবর লজ্জায় প্রকাশ করা হয় না। রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। দেশে পুলিশ প্রশাসন বলতে কিছু থাকলে এত দুঃসাহস পুলিশের থাকত না। জজ-বিচারকরা জেনে-শুনেই রিমান্ড-ব্যবস্থা সহজ করেছেন। মামলা দিলেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নেয়ার পুলিশি ব্যবস্থা থাকা তো অর্থেরও অপচয়।

বিচারব্যবস্থায় এখন দুর্নীতির ব্যবসা ভালোই চলছে। বস্তুত বিচারক, আইনজীবী ও পুলিশের এটা সম্মিলিত ও পবিত্র দায়িত্ব সমাজকে সদয় ও ন্যায়পরায়ণ রাখা।

(লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট)