নিজস্ব প্রতিবেদক:
জাহাজ রপ্তানি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আশার আলো দেখাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে জাহাজ আমদানি করতে চাইছে। বিগত কয়েক বছরে দেশের শিপইয়ার্ডগুলো ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে ৪০টি জাহাজ রপ্তানি করে। তাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জাহাজ যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করা হয়েছে। দেশের অন্য উদ্যোক্তারাও জাহাজ শিল্পে নতুন স্বপ্ন দেখছেন। জাহাজ নির্মাণে অনুকূল পরিবেশ থাকায় উদ্যোক্তাদের এ খাতে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আমদানিকারকরা আগ্রহী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প বিশ্ববাজারে ছোট ও মাঝারি নৌযানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে গত এক দশকে এ খাতের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং জাহাজ নির্মাণ খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ জ্বালানি, ৭০ শতাংশ কার্গো এবং ৩৫ শতাংশ যাত্রী নৌপথে পরিবাহিত হয়, যা দেশের অভ্যন্তরে জাহাজের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি করেছে। দেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় ৩০০ শিপইয়ার্ড রয়েছে। তবে তার মধ্যে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানিযোগ্য জলযান তৈরি করে। বর্তমানে জাহাজ নির্মাণ খাতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ জড়িত। অভ্যন্তরীণ বাজার ১০-১৫ শতাংশ হারে এবং রপ্তানি বাজার ৫-৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। বর্তমানে ১শ’টিরও বেশি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং ১২০টিরও বেশি নানা আকারের নিবন্ধিত শিপইয়ার্ড রয়েছে। দেশে ছোট-বড় মিলে পায় তিন শতাধিক শিপইয়ার্ড রয়েছে। তার মধ্যে ১০টি রপ্তানিযোগ্য জাহাজ তৈরি করে। জাহাজ নির্মাণ খাতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ জড়িত। বর্তমানে জাহাজের বার্ষিক নির্মাণ সক্ষমতা রপ্তানি আদেশের জন্য কমবেশি ২০ ধরা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য স্থানীয়ভাবে নির্মিত নৌযানের মধ্যে রয়েছে এমপিভি, কন্টেনার, বাল্কার, ট্যাঙ্কার, ড্রেজার, টাগ এবং যাত্রীবাহী ফেরি। আকারে ওসব ১-২০ হাজার ডিডব্লিউটির মধ্যে। বাংলাদেশের জাহাজ শিল্প বিগত ২০১৮ সাল থেকেই বৈশ্বিক বাজারে আবারো অবস্থান ফেরাতে শুরু করেছে। ইউরোপের বাজারে পরিবেশবান্ধব জাহাজের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাহাজ রপ্তানিতে নতুন নতুন অর্ডার আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশও এখন পরিবেশবান্ধব জাহাজ নির্মাণ করছে। বিগত ২০০৮ সালে ডেনমার্কে অত্যাধুনিক কন্টেনার জাহাজ ‘স্টেলা মেরিস’ রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রথম জাহাজ রপ্তানি শুরু হয়। তারপর মাত্র দুই বছরে বিভিন্ন দেশে ১১টি জাহাজ রপ্তানি হয়।
সূত্র জানায়, দেশের উদ্যোক্তারা জাহাজ শিল্পে নতুন স্বপ্ন দেখছে। জাহাজ নির্মাণে অনুকূল পরিবেশ থাকায় ওই খাতে উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের উপকূলীয় দেশগুলো সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা-ে জোর দিচ্ছে। সমুদ্র থেকে মৎস্য ও খনিজ সম্পদ আহরণ, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, সামুদ্রিক পর্যটন, সমুদ্র নিরাপত্তা ও গবেষণা ঘিরে কর্মযজ্ঞ বাড়ছে। সেজন্য উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত ছোট-বড় জাহাজ সমুদ্র অর্থনীতির ওসব কর্মকা-ের জন্য প্রয়োজন। ইতোমধ্যে জাহাজ ভাড়া ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। আর বিশ্ববাজারেও ব্যাপক হারে বেড়েছে জাহাজের চাহিদা। দেশে রপ্তানিকারকরা তার সুফল পাচ্ছে। প্রতিদিনই অর্ডার মিলছে। পাশাপাশি সরকারও এ খাতের রপ্তানি বাড়াতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা, কর ছাড়সহ নানা প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। ওই খাতে ব্যাংকগুলোও মোটা অঙ্কের অর্থায়ন করেছে। একটি নীতিমালাও করা হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উন্নয়ন, পরিচালনা ও বিকাশের লক্ষ্যে ২ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করেছে। তাতে প্রত্যাশা করা হচ্ছে জাহাজ রপ্তানি থেকে বছরে ৪ বিলিয়ন ডলার আয় হবে।
সূত্র আরো জানায়, জাহাজ রপ্তানি থেকে বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় করে। বিশ্ববাজারে সম্ভাবনা থাকায় ২০২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার ধরা হলেও তখন রপ্তানিকারকরা কোনো জাহাজই রপ্তানি করতে পারেনি। ওই কারণে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় মাত্র ২ হাজার ডলার। মহামারীর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নামমাত্র ওই লক্ষ্য ধরে সরকার। তারপরও অর্থবছর শেষে ওই খাত থেকে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। তবে ওই সময় জাহাজ রপ্তানিকারকরা প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু এরপর আবার ঘুরে দাঁড়ায় জাহাজ রপ্তানি। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় জাহাজের চাহিদাও ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ১০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়।
এদিকে ইরান ও ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে জাহাজ আমদানিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক উইংয়ে ওই আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। ভারতের নয়াদিল্লীতে অবস্থিত বাণিজ্যিক উইংয়ে বাংলাদেশে নির্মিত জাহাজ আমদানিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে একটি প্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, জাহাজ নির্মাণ শিল্প এক সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত। অত্যাধুনিক জাহাজ নির্মাণে আমাদের দক্ষতা রয়েছে। প্রত্যাশা করি ভবিষ্যতে এ শিল্প তৈরি পোশাক শিল্পের কাছাকাছি রপ্তানি আয় অর্জন করতে পারবে। সমুদ্রসীমা জয় করলেও আমরা সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে পারিনি। অনেক পিছিয়ে আছি। সম্ভাবনাময় এ খাকে এগিয়ে নেয়া জরুরি। সরকার তা গুরুত্ব দিয়ে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, মাতারবাড়ী, মোংলা, পায়রাসহ সব বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ