July 27, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, November 2nd, 2023, 11:43 am

জুড়ীতে চুরির অপবাদে শিক্ষার্থী ও পিতাকে মারপিটের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, ক্লাস বর্জন

জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার :

মৌলভীবাজারের জুড়ীর শিলুয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ল্যাপটপ চুরির অপবাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও তার পিতা নৈশপ্রহরীকে বেধড়ক মারপিট করে আহত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আহতরা বর্তমানে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদিকে এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ প্রতিবাদ করে মারধরের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানায় এবং প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির অপসারণেরও দাবি জানায়।

প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এবং হাসপাতালে ভর্তি থাকা শিক্ষার্থী ও তার পিতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নে অবস্থিত শিলুয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে নৈশপ্রহরী পদে চাকুরী করছেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা অলি উল্লাহ’র ছেলে মব উল্লাহ (৫৩)। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের একটি কোয়ার্টারে থেকে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন এবং বিদ্যালয় দেখাশুনা করছেন। তাঁর ৫ মেয়ে ও ১ ছেলে সন্তান রয়েছে। একমাত্র ছেলে ইউসুফ আলী জিসান (১৭) একই প্রতিষ্ঠানের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী। ২০২৪ সালে সে এই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে।

সম্প্রতি ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন লেমন, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মোঃ তাজুর রহমান, সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ আবুল কাশেম প্রতিষ্ঠানের নৈশপ্রহরী মব উল্লাহ’কে স্বেচ্ছায় চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার প্রস্তাব দেন। কারণ এই পদে সভাপতি ও অধ্যক্ষের পছন্দের একজন লোককে নিয়োগ দেয়া হবে। তাদের কথায় মব উল্লাহ রাজি না হওয়ায় সভাপতি, অধ্যক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষক নৈশপ্রহরীর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। এরপর থেকে তাকে বিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে চাকুরীচ্যুত করার জন্য নানা পায়তারা চালিয়ে যান। সর্বশেষ গত দুর্গাপূজার সময় বিদ্যালয় সরকারিভাবে বন্ধ ছিল।

বন্ধের সময় বিদ্যালয়ের ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব থেকে একটি ল্যাপটপ চুরি হয় বলে অভিযোগ কর্তৃপক্ষের। পরে সেই ল্যাপটপটি নৈশপ্রহরী মব উল্লাহ’র ছেলে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইউসুফ আলী জিসান চুরি করে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ তুলে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিদ্যালয় বন্ধের পর ওই ল্যাপটপটি পাওয়া যায় সহকারী প্রধান শিক্ষকের টেবিলের ড্রয়ারে। সেই অভিযোগ তুলে নৈশপ্রহরী মব উল্লাহকে ডেকে এনে চাপপ্রয়োগ করে জিজ্ঞাসা করেন সভাপতি, অধ্যক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও কমিটির অন্যান্য লোকজন।

এসব অপবাদ দিয়ে বুধবার (১ নভেম্বর) দুপুরে বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিলনায়তনে বৈঠকে বসে স্কুল কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন গোয়ালবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, বিদ্যালয়ের সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন লেমন, অধ্যক্ষ মোঃ তাজুর রহমান, সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ আবুল কাশেম, অভিভাবক সদস্য ও আওয়ামীলীগ নেতা জিল্লুর রহমান, স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল, সাবেক ইউপি সদস্য কাদির ও মছব্বিরসহ বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষক ও কমিটির লোকজন। বৈঠকে শিক্ষার্থী জিসানকে ল্যাপটপ চুরির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে সে ল্যাপটপ চুরি করেনি বলে উপস্থিত সবাইকে জানায়। তখন তার পিতা নৈশপ্রহরী মব উল্লাহর কাছে কৈফিয়ত চান যে তোমার ছেলে ল্যাপটপ চুরি করেছে সেটা তাকে স্বীকার করতে হবে না হলে তোমার চাকরী থাকবেনা।

এসব কথা শুনার পরও শিক্ষার্থী জিসান ল্যাপটপ চুরির বিষয় স্বীকার না করায় শিক্ষক মিলনায়তনের দরজা বন্ধ করে প্রথমে গোয়ালবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কাইয়ুম জিসানকে মারধর করেন। এরপর তার সাথে সঙ্গ দিয়ে জিসানকে মারধর করেন বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ তাজুর রহমান, ইউপি সদস্য আব্দুল, সাবেক ইউপি সদস্য মছব্বির ও কাদির। এসময় মব উল্লাহ তাদের কথা না শুনায় উপস্থিত নেতৃবৃন্দরা তাকেও মারপিট করে চুরির বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য করেন। পরে জিসান নির্যাতনকারীদের মারপিট সহ্য করে পিতার কথা শুনে বাধ্য হয়ে চুরির বিষয়টি স্বীকার করে নেয়। পরে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাদাকাগজে জিসানের স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি নেন এবং তার পিতা মব উল্লাহ’র লিখিত স্বাক্ষর নেন। পরে মবউল্লাহকে চুরির কাজে সহায়তার অভিযোগ এনে তাকে বিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করেন। বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে মব উল্লাহ ও তার ছেলেকে স্থানীয় এলাকার লোকজন কুলাউড়া উপজেলা হাসপাতালের জরুরী বিভাগের নিয়ে আসেন। মব উল্লাহকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেলে জিসানকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে জিসান কুলাউড়া হাসপাতালে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে।

এদিকে শিক্ষার্থী জিসানকে চুরির অপবাদ দিয়ে মারধর করে গুরুতর আহত করার ঘটনায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত টানা ৪ ঘন্টা ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ করে। এসময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে কমিটির সভাপতি, অধ্যক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষকের অপসারণের দাবি করেন। এবং তাদের সহপাঠী শিক্ষার্থী জিসানকে মারধরের ঘটনায় জড়িত সকলের বিচার চান। বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ও জিসানের সহপাঠী গৌতম পাশী, চন্দন দাস, রানা গোয়ালা, শুভ শীল, আল-আমিন, হৃদয়, নাঈম, প্রণব ও শম্ভুসহ প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, আমাদের সহপাঠীকে মিথ্যা চুরির অভিযোগ দিয়ে অন্যায়ভাবে বেধড়ক মারপিট করে গুরুতর আহত করা হয়েছে। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই এবং কমিটির সভাপতি, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের অপসারণ চাই। তাদের অপসারণ না হলে আমরা ক্লাস বর্জন করে লাগাতার আন্দোলন করবো।

শিক্ষার্থী জিসান জানায়, স্কুলের বন্ধের সময় আমি বাড়িতে ছিলাম না। শ্রীমঙ্গলে আনসার ভিডিপির প্রশিক্ষণে ছিলাম। তারপরও বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষক,চেয়ারম্যান- মেম্বাররা মিলে চুরির অপবাদ দিয়ে আমাকে অনেক মারপিট করেছেন। বিশেষ করে চেয়ারম্যান কাইয়ুম তার পায়ের বুট জুতা দিয়ে আমার মুখে লাথি দেন এবং আমার দুই হাতের ওপরে উঠে লাথি দেন। অধ্যক্ষ আমার তলপেটে লাথি দিলে আমার অন্ডকোষে আঘাত লাগে। আমার সমস্ত শরীরের নির্যাতনের অনেক চিহ্ন রয়েছে। প্রচন্ড ব্যথা করছে। বুধবার রাত থেকে পস্রাব করতে সমস্যা হচ্ছে।

নৈশপ্রহরী মব উল্লাহ বলেন, আমি ১৯৯৮ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করছি। প্রায় সময় বিদ্যালয়ের বর্তমান কমিটির সভাপতি ও অধ্যক্ষ চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার জন্য চাপপ্রয়োগ করেন। বিদ্যালয়ে যেকোন কিছু চুরি হলে আমাকে তারা সেই চুরির অপবাদ দেন। সর্বশেষ আমার ছেলেকে ল্যাপটপ চুরির অপবাদ দিয়ে চেয়ারম্যান, অধ্যক্ষ, ৩ জন ইউপি মেম্বার বেধড়ক মারপিট করে। কিন্তু ল্যাব থেকে ল্যাপটপটি নিয়ে এসে সহকারী প্রধান শিক্ষক তার ড্রয়ারে রেখে উল্টো আমার ছেলেকে ফাঁসিয়েছেন। এ অপবাদ এনে আমাকে মারপিট করে ছেলে চুরি করেছে বলে বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য করায় তারা। আমি নিজের ছেলের প্রাণ রক্ষার্থে চুরির বিষয়টি স্বীকার করতে ছেলে বলি। তখন সে দায় স্বীকার করলে তারা লিখিত স্বাক্ষর নিয়ে আমাকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে। আমি এ ঘটনার ন্যায় বিচার চাই।

কুলাউড়া হাসপাতালের কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ডাঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, রোগীর শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাছাড়া কোমর ও দুই হাতের এক্স-রে পরীক্ষা করার জন্য রোগীকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ আবুল কাশেম বলেন, শিক্ষার্থী জিসান ডিজিটাল ল্যাব থেকে ল্যাপটপ নিয়ে আমার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেয়। স্কুল খোলার পর ড্রয়ার খুলতে দেখা যায় ল্যাপটপটি জিসান নামে পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা। এতেই প্রমাণ হয় সে ল্যাপটপ বিক্রির উদ্দেশ্যে চুরি করে। পরে বুধবার বৈঠকে শিক্ষার্থী জিসানকে চুরির বিষয়টি স্বীকার করাতে তাকে মারধর করেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান।

গোয়ালবাড়ী ইউপি’র চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল কাইয়ুম শিক্ষার্থী জিসানকে মারধরের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ঘটনার দিন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি আমাকে জানান একটি ল্যাপটপ চুরি হয়েছে। চুরকে আটক করে স্কুলে রাখা হয়েছে। খবর পেয়ে আমিও স্কুলে যাই। পরে শিক্ষক মিলনায়তনে বৈঠকে শিক্ষার্থী জিসানকে জিজ্ঞাসা করা হয় সে ল্যাপটপ চুরি করেছে কিনা। কিন্তু সে প্রথমে স্বীকার না করায় তাকে আমি ধমক দিয়ে তার দুই হাতে কয়েকটি বেত্রাঘাত করেছি। তাছাড়া আমি তার শরীরের অন্য কোন স্থানে আঘাত করিনি। আর কেউ যদি মেরে থাকেন তাহলে আমি সেট জানিনা।

প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মোঃ তাজুর রহমান শিক্ষার্র্থীকে মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, দুর্গাপূজার বন্ধের সময় প্রতিষ্ঠান থেকে একটি ল্যাপটপ চুরি হয়। সেই চুরির বিষয়ে বুধবার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও গভর্নিং বডির সভাপতিসহ অন্যান্যরা বৈঠকে বসেন। বৈঠকে তদন্তের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী জিসান চুরির বিষয়টি স্বীকার করে নেয়। তবে আমি জিসানকে কোন মারধর করিনি।

প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন লেমন বলেন, ল্যাপটপ চুরির বিষয়টি শিক্ষার্থী জিসান স্বীকার করেছে। বুধবার বিষয়টি চেয়ারম্যানকে জানালে তিনি বিদ্যালয়ে এসে জিসানকে কয়েকটি বেত্রাঘাত করেন। মেম্বারও বেত্রাঘাত করেন। চুরির ঘটনায় ছেলেকে চাবি দিয়ে সহযোগিতা করার কারণে নৈশপ্রহরীকে গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তমতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ আনোয়ার বলেন, সন্দেহমুলকভাবে চুরির অপবাদ দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে যে বা যাহারা মারধর করেছেন সেটা ঠিক হয়নি। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করেছে সেটা শুনেছি। এরকম অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি করা মোটেই উচিত নয়। বিষয়টি নিয়ে ইউএনও মহোদয়ের সাথে কথা বলে সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গিয়ে তদন্তপূর্বক পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।