গত এক দশকে ডিমের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি বাড়লেও বাজার তদারকি এবং সরবরাহের চ্যালেঞ্জের কারণে ডিমের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে গ্রাহকেরা প্রতি ডজন ডিমের জন্য প্রায় এক কেজি ব্রয়লার মুরগি কেনার সমান টাকা খরচ করছে।
এক ডজন ফার্মের মুরগির ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। দেশি মুরগির ডিম কোথাও কোথাও প্রতি ডজন ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতি ডজন লাল ডিম বা ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকায়; সাদা ডিম ১৫০-১৬০; দেশি ডিম ২২০-২৩০ টাকা এবং হাঁসের ডিম ২০০-২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া মহল্লার দোকানগুলোয় প্রতি পিস ডিম ১৫ থেকে ১৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বারিধারা নতুনবাজার মালিক সমিতির সভাপতি আলম জানান, আমি মনে করি বাজার অব্যবস্থাপনার কারণেই ডিমের দাম বার বার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে সরবরাহের অব্যবস্থাপনা ও বাজারে তদারকির অভাব রয়েছে। সময়ে সময়ে কোনো একটি পণ্যের দাম হুট করে বাড়লে তার কারণ চিহ্নিত করতে হবে।
তিনি বলেন, লোক দেখানো বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা বাদ দিয়ে বাজারে হুট করে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে দেওয়া বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। না হলে ডিমের দাম যে হারে বাড়ছে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
গুলশান কাঁচা বাজারে ডিম ক্রেতা নাদিম জানান, বাজার মনিটরিং ব্যবস্পনায় দুর্বলতা রয়েছে, ফলে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামত হুট করে দাম বাড়াচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। একটি ডিমের উৎপাদন খরচ কত আর ব্যবসা করবে কতটা টাকা, এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তদারকি না থাকলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারী প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার জানান, বাজার ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই সমন্বয় থাকতে হবে। তদারকি জোরদার করতে হবে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে ডিম-মুরগির দাম যৌক্তিক হারে সমন্বয় হতে হবে। তাহলে খামারিরা উৎপাদন বন্ধ করবেন না। তাতে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে।
তিনি আরও বলেন, কোনো চক্র যাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে না পারে, তা দেখার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। তা না হলে ডিম দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, এক সপ্তাহ আগেও বাজারে ফার্মের ডিমের দাম ছিল প্রতি ডজন ১৪০-১৫০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ডিম উৎপাদক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার কোটি ডিমের প্রয়োজন হয়। আর ডিমের একটি বড় অংশ আসে সারা দেশের খামারগুলো থেকে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ১০ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ কোটি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে বাজারে ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিমের হালি ছিল ৩৪ টাকা। বর্তমানে বাজারের ফার্মের মুরগির ডিমের হালি ৫৫-৬০ টাকা।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানান, ‘আমাদের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সার্ভে অনুযায়ী, একটি ডিম উৎপাদনে সাড়ে ১০ টাকার ওপর খরচ পড়ে। তারপর অন্যান্য ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে কিছু লাভের বিষয় থাকে। আমার কাছে মনে হয়েছে, একটি ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি নির্ধারিত হওয়া উচিত না। এই ১২ টাকা নির্ধারিত হলে যারা উৎপাদনকারী তাদেরও লাভ হবে। এর বাইরে কেউ অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করলে ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় যারা কর্তৃপক্ষ, তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা উৎপাদনকারীদের বিভিন্নভাবে অনুরোধ করেছি, বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এরপরেও যদি কেউ জনদুর্ভোগ ডেকে আনে, তা দেখভাল করার জন্য ভোক্তা অধিকার আইন আছে। ভোক্তাদের অধিকার দেখার জন্য কর্তৃপক্ষ আছে। তারা প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেবেন।’
মন্ত্রণালয় দাম নির্ধারণ করে দেবে কিনা- এ বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, এটা দাম নির্ধারণ করার বিষয় না। এরআগে ২০১০ সালে ছোট বাচ্চা মুরগি ও অন্যান্য বিষয়ের দাম নির্ধারণের বিষয় উঠেছিল। সেক্ষেত্রে আদালত প্রশ্ন তুলেছিলেন, মন্ত্রণালয় এভাবে দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে না।
রবিবার (১৪ আগস্ট) সকালে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাইলেই ডিম আমদানি করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইমপোর্ট পারমিশন লাগবে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া ডিম আমদানির সুযোগ নেই। আমি আশা করবো শিগগিরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গ্রিন সিগন্যাল দিলেই ডিম আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
বাণিজ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বলেন, ‘ডিম আমদানি করা না করার বিষয়টি আমরা অন্যভাবে বিবেচনা করবো। এই বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইন্ডিপেন্ডেন্টলি বিবেচনা করবে কি করবে না এটা তাদের বিষয়। আমার কাছে মনে হয়েছে দেশে যে উৎপাদন আছে, আমরা যদি বাজার ব্যবস্থা বিন্যাস করতে পারি তবে আমদানির কোনো প্রয়োজন হবে না।’
বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাজারে ডিমের দাম কত হবে তা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দিলে আমাদের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ডিমের বাজার হঠাৎ অস্থিতিশীল হওয়ায় ভোক্তা অধিকার রাতে-দিনে রাজধানীর বিভিন্ন আড়তে অভিযান চালাচ্ছে এবং জরিমানা করছে।’
—-ইউএনবি
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ