November 4, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, July 18th, 2022, 9:19 pm

তীব্র গরমে বাড়ছে ডায়রিয়া-জ্বর, বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা

এম. মছব্বির আলী, মৌলভীবাজার:

দীর্ঘ বন্যা পরবর্তী প্রাদুর্ভাব ও গত এক সপ্তাহের তীব্র তাপদাহে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় জনজীবনে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। এর সাথে বেড়েছে জ্বর-ক্বাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ নানা রোগবালাই। প্রতিদিন এসব রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হয়ে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্হিবিভাগ ও জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। এসব রোগীর মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বেশি। চিকিৎসকদের পরামর্শ এই সময়ে হালকা এবং সুষম খাবার, প্রচ- রোদে চলাফেরায় সাবধানতা ও বিশুদ্ধ পানি পানসহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।

এ অঞ্চলের আবহাওয়া অধিদপ্তর শ্রীমঙ্গল কার্যালয় সূত্রে ও স্থানীয়দের ভাষ্যমতে জানা যায়, গত কয়েকদিনে তাপমাত্রা বেড়েছে। প্রতিদিনই দিনে ৩৫ ডিগ্রির ওপরে তাপ প্রবাহ চলছে। রাতে হঠাৎ বৃষ্টিতে কিছুটা গরমের তীব্রতা কমলেও ভ্যাপসা গরম অনুভূত হয়। গরমের তীব্রতার সাথে বিদ্যুৎয়ের লোডশেডিংয়ে অনেকটাই বিপর্যস্ত জনজীবন। গত শনিবার রাতে প্রায় তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন অবস্থায় ছিলেন উপজেলার ৩২ হাজার গ্রাহক। রাতে উপজেলার পৌর শহরসহ কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও ব্রাহ্মণবাজার, কাদিপুর, ভূকশিমইল, জয়চন্ডী ইউনিয়নের অনেক গ্রামের মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছেন।

আবহাওয়া অধিদপ্তর শ্রীমঙল কার্যালয়ের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক মুজিবুর রহমান জানান, ১৮ জুলাই সোমবার মৌলভীবাজার জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫.৭ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৬.৪ থাকবে। আগামী দুই একদিনের মধ্যে ঝড়ো বাতাসের সাথে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, গত রোববার (১০ জুলাই) থেকে সোমবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত হাসপাতালের আবাসিক ওয়ার্ডে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৬০ জন রোগী ভর্তি হন। এরমধ্যে ৪৫ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। গরমজনিত জ¦র, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়ে ১৭ জন ভর্তি হয়ে সুস্থ হয়েছেন ১০ জন। খিঁচুনী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৭জন ভর্তি হয়ে ৪ জন সুস্থ হয়েছেন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৭ জন ভর্তি হয়ে ৪জন সুস্থ হয়েছেন। এছাড়াও হাসপাতালের জরুরী ও বর্হিবিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৫ শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে জ¦র সর্দি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত গড়ে দুই শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে যান। যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।

সরেজমিন হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের দুটি ওয়ার্ডে শিশুসহ অন্যান্য রোগীরা ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেক রোগী তীব্র গরমে হাসফাস করছেন। একদিকে প্রচন্ড গরম ও অন্যদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক শিশু রোগীর মা তাদের বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় চেয়ারে বসে আছেন কেউ বা দাঁড়িয়ে আছেন। এসময় এই প্রতিবেদককে দেখে অনেক রোগী অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ও নোংরা পরিবেশে বাচ্চাদের সাথে অভিভাবকরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছি। বিশেষ করে ওয়ার্ডের ফ্লোর, বাথরুম ও বেসিনের অবস্থা খুবই অপরিচ্ছন্ন। দুর্গন্ধে দুর্বিসহ হয়ে পড়ছে হাসপাতালের পরিবেশ।

হাসপাতালে ভর্তি উপজেলার রাউৎগাঁও ইউনিয়নের মনরাজ গ্রামের বাসিন্দা এক বছর বয়সী শিপা বেগমের মা হালিমা বেগম বলেন, আমার মেয়ের প্রথমে খুব বেশি ক্বাশি ছিল। পরে নিউমোনিয়া ধরা পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করি। ৪দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হাসপাতালে বাথরুমের প্রবেশদ্বারে বেসিন, ওয়ার্ডের ফ্লোর ও আশপাশ খুবই অপরিচ্ছন্ন। গরমের সাথে এমন অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকতে গিয়ে বাচ্চাদের সাথে নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি।

বরমচাল ইউনিয়নের আকিলপুর গ্রামের বাসিন্দা ১৩ মাস বয়সী শিশু তাবাসসুম জান্নাতের মা আমিনা বেগম বলেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে আমার মেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। দুই দিন ধরে হাসপাতালে রয়েছি। বিদ্যুৎ চলে গেলে তীব্র গরমে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালের বেডে থাকা ভীষণ দায়।

রবিরবাজার এলাকার বাসিন্দা এক বছরের ভর্তি রোগী শুভ্র’র মা দীপা রাণী চন্দ্র বলেন, আমার ১ বছর বয়সী ছেলের তিন দিন ধরে জ¦র ছিল। পরবর্তীতে প্রচন্ড গরমে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি করি।

জয়চন্ডী ইউনিয়নের দিলদারপুর চা-বাগানের বাসিন্দা ১৭ মাস বয়সী অনুপার মা লিপি রায় বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে আমার মেয়েটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা চলছে এক সপ্তাহ ধরে।

কুলাউড়া সদর ইউনিয়নের করেরগ্রামের বাসিন্দা মাহফুজুর রহমান শাকিল জানান, গত কয়েকদিনের তীব্র গরমে আমার একবছরের মেয়ে ও এগারো মাসের দুই জমজ ভাতিজির জ্বর-ক্বাশির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গরমে বুক ঘেমে গিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে চিকিৎসা দিচ্ছি। তীব্র গরমের সাথে বিদ্যুৎয়ে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে খুবই অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। এজন্য বিকল্প হিসেবে দুটি বৈদ্যুতিক চার্জার ফ্যান কিনতে বাধ্য হয়েছি।

কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা: জাকির হোসেন বলেন, প্রতিদিন হাসপাতালের জরুরী ও বর্হিবিভাগে জ¦র-ক্বাশি, ডায়রিয়ায় চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় দুই শত রোগী। এরমধ্যে জ্বর-ক্বাশিতে প্রায় ১০০ শিশু ও ডায়রিয়ায় ২০-২৫ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এসময় গরম এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। বিশেষ করে শিশুদের শরীর ঘেমে গেলে দ্রুত পরিষ্কার শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে। শরীর ঘেমে ঘিয়ে শিশুদের যাতে বুকে ঠান্ডা না লাগে সে দিকে শিশুর মা-বাবার লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া প্রত্যেক শিশুদের বাড়তি যত্ন নেওয়ার জন্য সব শিশুর মাকে আরো সচেতন হতে হবে। শাক সবজিসহ সুষম খাবারসহ ভিটামিন সি যুক্ত খাবার ও বিশুদ্ধ নিরাপদ পানি বেশি করে পান করতে হবে। গরুর মাংস ও অধিক চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। বেশি ঘামলে ওর স্যালাইন খেতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া সূর্যের আলোয় ঘর থেকে যাতে কেউ বের না হোন সেদিকে একটু লক্ষ্য রাখতে হবে।

 

কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: ফেরদৌস আক্তার বলেন, কুলাউড়ায় বন্যার প্রাদুর্ভাব ও তীব্র গরমে মানুষ জ¦র, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়াসহ নানা রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন হাসপাতালের জরুরী ও বর্হিবিভাগে জ¦র-ক্বাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে প্রায় ৪৫০-৫০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা রোগীদের সর্বোচ্চ দিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতালে রোগীদের করা অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একদিকে জনবহল সংকট রয়েছে অন্যদিকে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও স্বজনরা যত্রতত্র ময়লা ও খাবার ফেলে দেন। এজন্য অপরিচ্ছন্নতার সৃষ্টি হয়। পরিচ্ছন্নতাকর্মী তিনজনের মধ্যে একজন দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা নিয়মিত হাসপাতাল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করছি।