নিজস্ব প্রতিবেদক:
দাম বেশি হলেও সে অনুপাতে ইন্টারনেটের গতি পাওয়া যায় না। এটি নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ ও অসংখ্য অভিযোগ। কিন্তু তারপরও অবস্থার তেমন উন্নতি দেখা যায় না। সম্প্রতি ভিপিএন সেবাদানকারী প্ল্যাটফর্ম ‘সার্ফ শার্ক’ কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল ইন্টারনেট ভ্যালু ইনডেক্স (আইভিআই) শীর্ষক একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশিরা ইন্টারনেট ব্যবহারে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রায় ৬ দশমিক ৯ গুণ বেশি অর্থ খরচ করছে।
ইন্টারনেটের জন্য যে খরচ করা হয়, সে রকম সেবা পাওয়া যাচ্ছে কি না তার ওপর ভিত্তি করে গ্লোবাল ইন্টারনেট ভ্যালু ইনডেক্স তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে ইন্টারনেট ব্যবহারে কোনো দেশ কেমন খরচ করে, তার একটি ক্রমতালিকা প্রকাশ করা হয়। এ তালিকায় বিশ্বের মধ্যে ৮৩তম এবং আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ অবস্থান তৃতীয়।
সার্ফ শার্ক বলছে, বাংলাদেশের ইনডেক্স ০.০১০৫, যা বৈশ্বিক গড় ইনডেক্স থেকে প্রায় ৮৬ শতাংশ কম। এর অর্থ, বাংলাদেশিদের ইন্টারনেট সেবা পেতে অতিরিক্ত অর্থব্যয় করতে হচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে বিশ্বের মাত্র ২৪ শতাংশ দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি অর্থব্যয় করে। সার্ফ শার্কের ইন্টারনেট ভ্যালু ইনডেক্স হিসাবের জন্য প্রতি দেশের ইন্টারনেটের গতিকে ওই দেশের নাগরিকদের ইন্টারনেট ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে ভাগ করা হয়। ভাগফল থেকে নির্ধারণ করা হয় কোনো দেশের নাগরিকরা ইন্টারনেটের জন্য অতিরিক্ত অর্থব্যয় করছে কি না।
তবে দামের হিসেবে নয়, গতির হিসেবে ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের প্রতিষ্ঠান- ওকলার তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৪২ দেশের মোবাইল ইন্টারনেট গতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম। যদিও গত বছরের তুলনায় এটি ছয় ধাপ অগ্রগতি।
আন্তর্জাতিকভাবে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ডাউনলোডের জন্য ২৯ দশমিক ৯৬ এমবিপিএস আর আপলোডিংয়ের জন্য ৮ দশমিক ৭০ এমবিপিএস। সেখানে বাংলাদেশের বর্তমান গতি রয়েছে ১০ দশমিক ৪৩ এমবিপিএস। তুলনামূলক দাম বেশি ও গতি কম হওয়া সত্বেও ইন্টারনেটের দামের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে বাংলাদেশ।
গতমাসে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) ও বৈশ্বিক ইন্টারনেট ফোরাম অ্যালায়েন্স ফর অ্যাফোর্ডেবল ইন্টারনেটের (এফোরএআই) ‘দ্য অ্যাফোর্ডেবিলিটি অব আইসিটি সার্ভিসেস ২০২১’ নামের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বের বেশির ভাগ স্বল্পোন্নত দেশে ইন্টারনেটের দাম জাতিসংঘ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ছিল। তবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশসহ মাত্র চারটি দেশ জাতিসংঘ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে।
এ তালিকার বাকি তিন দেশ হলো ভুটান, মিয়ানমার ও নেপাল। আইসিটি সেবার সক্ষমতা শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রতি দুই জিবি মোবাইল ডেটাভিত্তিক ইন্টারনেটের জন্য মাসিক মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ ব্যয় হয়, যার মূল্য ২ দশমিক ৩২ ডলার। ক্রয় ক্ষমতার সমতার হিসাবে এ ব্যয় ৫ দশমিক ৯৮ ডলার। মোবাইল ইন্টারনেটের সাশ্রয়ী দামে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে ভারত, ভুটান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ জিবি তারযুক্ত অর্থাৎ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের জন্য মাসিক মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ ব্যয় হয়, যার মূল্য ৩ দশমিক ৩৯ ডলার। ক্রয়সক্ষমতার সমতার হিসাবে এ ব্যয় ৮ দশমিক ৭৩ ডলার।
ব্রডব্যান্ডে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ব্যয় কম। অবশ্য ইন্টারনেটের দাম পর্যালোচনাকারী ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কেবল ডট সিও ডট ইউকের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ২৩০টি দেশের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেটের কম দামের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ নম্বরে।
এদিকে দামের সঙ্গে গতির সমন্বয়হীনতার পাশিাপাশি রয়েছে সবার হাতে ইন্টারনেট না পৌঁছানোর মতো বিষয়ও। সূত্রমতে, বাংলাদেশে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ইন্টারনেট সংযোগহীন জনসংখ্যা রয়েছে। গ্লোবাল ডেটা রেফারেন্স লাইব্রেরি-ডেটা রিপোর্টালের ২০২৩ সালের গ্লোবাল ডিজিটাল ওভারভিউ রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ১০ কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে রয়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে ১০ কোটি ৫১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ (মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬১.১ শতাংশ) ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে ছিল এবং বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগহীন জনসংখ্যার দিক থেকে চতুর্থ বৃহৎ জনগোষ্ঠী রয়েছে বাংলাদেশে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যার তুলনায় বাড়েনি সেবার মানও। সমস্যার কথা স্বীকার করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমাদের দেশে মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা আছে। আমরা ২০১৮ সালে ফোরজির যুগে পৌঁছেছি। এর আগে টু-জি আর থ্রি-জির যুগে ছিলাম। টু-জিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যেত না আর থ্রি-জিতে সীমিত পর্যায়ে ব্যবহার করা যেত। তাতে সারাবিশ্বের সঙ্গে যখন তুলনা করা হয় তখন আমারতো গতি থাকবেই না। মন্ত্রী বলেন, আমার প্রযুক্তির গতি না থাকলে গ্রাহককে আমরা গতি দেবো কীভাবে? আমরা ২০১৮ সালে ফোরজি চালু করেছি। এরপর ২০২১ সালে তরঙ্গ নিলাম করেছি। তখন করোনার মধ্যে ছিলাম। ফলে প্রযুক্তি সম্প্রসারণের যে বিষয়টি ছিল সেটি করা সম্ভব হয়নি।
অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৯৮ শতাংশ অঞ্চলে ফোরজি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। নেটওয়ার্ক গড়ে তুললেও গ্রাহককে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। ফোরজির জন্য আপডেট করতে হবে সিম ও হ্যান্ডসেট। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশের উপরে স্মার্টফোন নিউট্রেশন করতে পারিনি। ফলে ব্যবহারকারীর কাছে যে গতিটা দেবো সেটি গ্রহণ করার যন্ত্রটাও তো তার কাছে থাকতে হবে। আমরা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি। তাতে মনে হয়েছে তরঙ্গ যদি থাকে তাহলে সমস্যার সমাধান করতে পারবো না। অপারেটররা এর আগে ১৫৬ মেগাহার্জ তরঙ্গ নিয়েছিল।
গত ৩১ মার্চ আমরা আরও ১৯০ মেগাহার্জ তরঙ্গ নিলাম করেছি। এই তরঙ্গটা নেটওয়ার্কে দিলে গতি ফিরে আসবে। আর খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে শহর এলাকায় জনঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। গ্রাহক অনুপাতে অপারেটরদের কাছে যে পরিমাণ তরঙ্গ থাকা প্রয়োজন তা বাংলাদেশের অপারেটরদের কাছে নেই। ভালো সেবা দেয়ার জন্য একেকটি অপারেটরের কাছে অন্তত ১০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ প্রয়োজন।
তরঙ্গের মূল্য আকাশচুম্বী হওয়ার পরও অপারেটররা তা ক্রয় করেছে। অন্যদিকে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় যেভাবে ভবন নির্মাণ করা হয় তাতে নেটওয়ার্ক ডিজাইন করা অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি ভালো নেটওয়ার্কের জন্য এক টাওয়ারের সঙ্গে আরেক টাওয়ারের মধ্যে অপটিক্যাল ফাইবারের সংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নানা জটিলতার কারণে টাওয়ারে ফাইবার সংযোগ আশানুরূপ নয়। এসব বিষয় নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে অপারেটররা কাজ করছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ