নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশজুড়েই প্রতিনিয়ত ব্যাপক হারে জলাভূমির ভরাট চলছে। কিন্তু জলাশয় রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ভূমিকা নেই। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওসব সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় জলাশয় ভরাটের অভিযোগ আসছে। গত তিন দশকে হাওর এলাকায় ৮৭ শতাংশ জলাভূমি কমেছে। ফলে হাওরাঞ্চলে বন্যার ব্যাপকতা বাড়ছে। এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ১৯৮৮ সালে দেশের ৩৭৩ হাওরে শুষ্ক মৌসুমে জলাভূমির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৩৫০ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু ৩২ বছরে তা কমে ২০২০ সালে প্রায় ৪০৭ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে হাওরাঞ্চলে সড়কসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো প্রায় পৌনে চার গুণ বেড়ে ১ হাজার ৩২ থেকে ৩ হাজার ৮৭২ বর্গকিলোমিটার হয়েছে। বিগত ২০০৬ সালে হাওর এলাকায় নির্মিত এলাকা (বিল্ট আপ এরিয়া) ২ দশমিক ২ গুণ এবং ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ গুণ বেড়েছে। পাশাপাশি আশঙ্কাজনকভাবে পতিত জমি, কৃষিজমি ও বনজ এলাকাও কমেছে। হাওরের বিভিন্ন জেলার মধ্যে ১৯৮৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে শুষ্ক মৌসুমে জলাভূমির পরিমাণ সিলেটে ৭৫ ভাগ, সুনামগঞ্জে প্রায় ৮০ ভাগ, নেত্রকোনায় প্রায় ৯০ ভাগ, কিশোরগঞ্জে প্রায় ৮৫ ভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় ৭০ ভাগ, হবিগঞ্জে প্রায় ৯০ ভাগ এবং মৌলভীবাজারে প্রায় ৭০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। পানি বিশেষজ্ঞদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঢাকার চারপাশে বহু এলাকার জলাভূমি ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। এখনো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গড়ে উঠছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর। প্রশাসনের সামনেই জলাভূমি ভরাট হচ্ছে। ভরাটের ফলে খালগুলো সরু ড্রেনে রূপ নিয়েছে। ২০১০ সালে যখন ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) করা হয়, তখন মূল ঢাকা শহরে জলাভূমি ছিল ৯ হাজার ৫৫৬ একর। ২০১৯ সালে তা কমে হয়েছে ৬ হাজার ৭৩ একর। ৯ বছরে ভরাট হয়েছে মোট জলাভূমির ৩৬ শতাংশ। ওই সময়ে সাভারে মোট জলাভূমির ১৫ শতাংশ, গাজীপুরে ১৭ শতাংশ, রূপগঞ্জে ৪১ শতাংশ ও কেরানীগঞ্জে ২১ শতাংশ ভরাট হয়েছে। ওই হিসাবে ড্যাপ বা ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় নির্ধারিত এক লাখ ৯৩৭ একর জলাভূমির মধ্যে ২০১৯ সাল নাগাদ ভরাট হয়েছে ২২ হাজার ৫১৬ একর, যা মোট জলাভূমির প্রায় ২২ শতাংশ। ৬টি এলাকায় মোট ৪১ শতাংশ জলাধার ভরাট হয়ে গেছে। ঢাকায় জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ আরো কয়েকটি সংস্থার। আর ঢাকার বাইরে জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং অ্যাসিল্যান্ড অফিসের।
সূত্র জানায়, সারা দেশে প্রতি বছর ৪২ হাজার একর কৃষিজমি ও জলাশয় ভরাট হচ্ছে। ভরাটের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি ভরাট হয়েছে। শুধু হাওরাঞ্চলই নয়, দেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিলের বড় অংশই ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমানে পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরের ৯ উপজেলার অংশ বিশেষ নিয়ে চলনবিলের বিস্তৃতি হলেও একসময় সেটি ওই তিন জেলাসহ পার্শ্ববর্তী বগুড়া ও নওগাঁ জেলাও অংশ ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে চলনবিল ছোট হয়ে আসছে। বছরের প্রায় ৫-৬ মাস ওই চলনবিলে পানি থাকলেও জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাবে সর্বশেষ বছরে এই চলনবিলে ভরা বর্ষাতেও পানিশূন্যতা দেখা দেয়। জলাভূমি ভরাটে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও নগরের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি শহরের বৃষ্টির পানি সুষ্ঠু নির্গমনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, আদর্শ একটি শহরের ১০-১৫ শতাংশ এলাকা জলাশয় থাকা প্রয়োজন; কিন্তু ঢাকা শহরে জলাভূমির পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অথচ ২০ বছর আগে জলাভূমির পরমাণ ছিল ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০১০ সালের ড্যাপে রাজউকের আওতাধীন ৩৭ লাখ ৭ হাজার ৫৭৭ একর জায়গার মধ্যে বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ছিল ৭৪ হাজার ৫৭১ একর। কিন্তু ১০ বছর পর রাজউকেরই এক জরিপ বলছে, ড্যাপ নির্ধারিত বন্যাপ্রবাহ এলাকায় ৭২ হাজার ১৮১টি ছোট-বড় স্থাপনা রয়েছে এবং ৯৯ দশমিক ৯৮ শতাংশই অবৈধ। ১৯৮৫ সালে মৎস্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজারের মতো। তবে রাজধানীর সীমানা বাড়লেও বর্তমানে মাত্র ২৪১টি পুকুর আছে। এদিকে এ বিষয়ে পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের ফাঁকফোকর ও উদাসীনতায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রকৃতির আঁধার জলাভূমি কমছে। কমছে পানির স্তর। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। সারা দেশে প্রতি বছর ৪২ হাজার একর জলাশয় ও কৃষিভূমি ভরাট হচ্ছে। অথচ প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এ বলা হয়েছে, নদী, খাল-বিল, হাওর, দীঘি, ঝরনা, বন্যাপ্রবাহ এলাকা, বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন সব এলাকা প্রাকৃতিক জলাধার, জলাশয় বা জলাভূমি হিসেবে পরিগণিত হবে। গত বছরের ২২ অক্টোবর ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরকেও প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, এই জলাধার কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না। কিন্তু জলাভূমি সংরক্ষণে সচেতনতার বড়ই অভাব রয়েছে। বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সারা দেশেই প্রশাসনের সামনেই পুকুরসহ জলাভূমি ভরাট করে ঘরবাড়ি-কলকারখানাসহ নানা অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। কোথাও কোথাও জলাশয় ভরাট করে সরকারি অবকাঠামোও গড়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ