নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের বন্দরগুলোতে বিলম্বে আমদানি পণ্য খালাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিজস্ব গবেষণার তথ্যানুযায়ী আমদানি পণ্যের চালান আসার পর তা খালাসে দেশের প্রধান দুই বন্দর ও কাস্টম হাউসে গড়ে ১০ দিন সময় লাগে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে পণ্যের চালান খালাসে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় লেগে যাচ্ছে ১১ দিন ৬ ঘণ্টা ২৩ মিনিট। আর বেনাপোল স্থল বন্দরে সময় লাগছে ১০ দিন ৮ ঘণ্টা ১১ মিনিট। তাছাড়া ঢাকা কাস্টম হাউসে সময় লাগে ৭ দিন ১১ ঘণ্টা ১৯ মিনিট। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ পণ্য খালাসে ১ মাসেরও বেশি সময় লাগে। কিছুকিছু ক্ষেত্রে কয়েক মাসও লেগে যাচ্ছে। তবে ঘুষ দিলে অবৈধ পণ্যও দ্রুত খালাস হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়ছে আমদানিকারকরা। তাছাড়া হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ ঢাকা কাস্টম হাউসকে কেন্দ্র করে চলছে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চোরাই পণ্য খালাসের মহোৎসব। মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিলে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ঘুষের দাবিকৃত টাকা না পেলে মাসের পর মাস আটক রাখা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের পণ্য। এককথায় ব্যবসায়ীরা জিম্মি। আর ঘুষের বিনিময়ে চোরাই পণ্য ঠিকই দ্রুত খালাস করে দেয়া হচ্ছে। ফলে সরকার প্রতি বছর কয়েকশ’ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে এনবিআরের অধীনে চট্টগ্রামসহ ৬টি বড় কাস্টম হাউস রয়েছে। আর ছোট শুল্ক স্টেশন ১৮৪টি। তার মধ্যে সক্রিয় শুল্ক স্টেশনের সংখ্যা ৩৭টি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, কমলাপুর আইসিডি ও ঢাকা কাস্টম হাউস আংশিক অটোমেটেড চালু হলেও বাকিগুলো এখনো তার বাইরে রয়েছে। যদিও ব্যবসায়ীরা যাতে হয়রানিমুক্ত পরিবেশে ও কম সময়ে রপ্তানিপণ্য খালাস করতে পারে ওই লক্ষ্যে এনবিআরের কাস্টমস বিভাগকে প্রায় ৯ বছর আগে কাগজবিহীন বা পেপারলেস করার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু এখনো কাস্টমস বিভাগের অধীনে দেশের কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশনগুলো প্রচলিত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চলছে। শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ধীরগতিতে হচ্ছে। ফলে এখনো ব্যবসায়ীদের পণ্যের শ্রেণীকরণ বা এইচএস কোড নিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে কাস্টমস বিভাগের পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট থেকে শুরু করে শুল্কায়নের সব কার্যক্রম কাগজ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বন্দরে পণ্য শুল্কায়ন ও খালাসে হয়রানি বন্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে। একই সঙ্গে তারা বন্দর ও কাস্টমসের সক্ষমতা বাড়ানোরও তাগিদ দিয়েছে। তাদের মতে, তা না হলে অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সক্ষমতায় দেশ পিছিয়ে পড়বে। তবে সম্প্রতি এনবিআরের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেশের প্রধান বন্দরগুলো থেকে আমদানি পণ্য খালাসের সময় কমিয়ে আনতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশে স্মার্ট কাস্টম হাউস ছাড়া বিকল্প নেই। কারণ দেশকে চীন, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কাস্টম হাউসে পণ্য শুল্কায়ন ও খালাস কাজ দ্রততম সময়ের মধ্যে করা জরুরি। কারণ বাণিজ্য সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আর হয়রানি করে শুধু কর আদায় করে বিশ্বে কোনো দেশের উন্নত হওয়ার নজির নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে দিয়ে সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও প্রতি কনটেইনার পণ্য শুল্কায়ন করতে অন্তত ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা স্পিডমানি দিতে হয়। আর কোনো কারণে ডকুমেন্টে ছোটখাটো ভুল থাকলে ওাই স্পিডমানির পরিমাণ অন্তত তিনগুণ বেড়ে যায়। কাস্টম হাউসে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না। বন্দরের জেটি শাখা ও কাস্টম হাউসের সংশ্লিষ্ট গ্রুপেই ঘুষের ৮০ শতাংশ অর্থ লেনদেন হয়।
সূত্র আরো জানায়, পণ্য নিয়ে জাহাজ আসার পর কাস্টম হাউসের অটোমেশন সিস্টেমে অনলাইনে বিল অব এন্ট্রি (আগাম চালান) দাখিল করতে হয়। তারপর আইজিএম, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, এলসি কপি, এলসিএ, ইন্স্যুরেন্স কপি, মেরিন পলিসি, কান্ট্রি অব অরিজিন সনদ ও বিল অব এক্সচেঞ্জের মূল কপি নিয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রুপের অ্যাপ্রেইজারের কাছে সশরীরে যেতে হয়। সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে বন্ডের পণ্য হলে জেটির ওয়ান স্টপ সার্ভিস পয়েন্টে ফাইল পাঠানো হয়। ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করে সহকারী কমিশনারের কাছে ফাইল নিতে হয়। তিনি পণ্য পরীক্ষার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। ওই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুষ দিতে হয়। তারপর বন্দর নিয়োজিত ইয়ার্ড ক্লার্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে কনটেইনার খোলার অনুমতি নিতে হয়। ইয়ার্ডে থাকা এএসআই থেকে নিতে হয় সিলগালা কার্ড। তারপর কার্পেন্টার দিয়ে কনটেইনার খোলা হয়। কাস্টমস কর্মকর্তারা কনটেইনারে থাকা পণ্য পরীক্ষা করে পরীক্ষার রিপোর্ট জেটি কাস্টম থেকে দেয়া হয়। ওসব প্রক্রিয়ায় জেটিতে বিভিন্ন ধাপে ঘুষ দিতে হয়। কোনো কারণে পরীক্ষণে পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিন কিংবা এইচএস কোড নিয়ে সন্দেহ হলে ঘুষের টাকার পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। জেটি থেকে পরীক্ষণ রিপোর্ট নিয়ে আবার কাস্টম হাউসের সংশ্লিষ্ট গ্রুপে যেতে হয়। সেখান থেকে বন্ড আউটপাস গ্রুপে ফাইল যায়। তারপর সহকারী কমিশনার শুল্কহার নির্ধারণ করে দিলে ফাইল আবার গ্রুপে আসে। সেখানে পুনরায় যাচাই-বাছাই শেষে ব্যাংকে শুল্কহার জমা দিলে পণ্য খালাসের ফাইনাল ছাড়পত্র দেয়া হয়। এসব প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে কাস্টম হাউসে ঘুষ দিতে হয়। কোনো কারণে ফাইলে ত্রুটি থাকলে সেখানেও ঘুষের অঙ্ক বেড়ে যায়। এভাবে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে আমদানি পণ্য খালাস করতে ব্যবসায়ীদের টাকা গুনতে হয়। অথচ অটোমেশন প্রক্রিয়া পূর্ণাঙ্গ থাকলে হয়রানির পাশাপাশি ঘুষের ধাপও অনেক কমে আসতো।
এদিকে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের মতে, বন্দরে আমদানি পণ্য আসার পর তা কোন শ্রেণির তা নির্ধারণ নিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমদানিকারকের প্রায়ই বাগবিতন্ডা হয়। তাতে পণ্য খালাসে কালক্ষেপণ হয়। ওই জটিলতা নিরসন হওয়া জরুরি। বর্তমানে একটি কাস্টমস হাউসে গড়ে দৈনিক তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার নথি ব্যবহার করা হয়। সব কাস্টম হাউস পুরোপুরি অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় হলে কাগজের কোনো ফাইল থাকবে না। তাতে পণ্য খালাসের সময় বাঁচবে এবং দুর্নীতি কমবে। ফলে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যও গতিশীল হবে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, বন্দর বা কাস্টমস হাউস থেকে পণ্য খালাস করতে বেশি সময় লাগার কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা পণ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠাতে হয়। তাতে পণ্য খালাস করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। যা ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে বন্দরে টেস্টিং ল্যাব স্থাপন জরুরি।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ