নিজস্ব প্রতিবেদক:
ধীরগতিতে চলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। ফলে বাড়ছে প্রকল্প ব্যয়ও। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে বাংলাদেশ রেলওয়ে এগিয়ে থাকলেও বাস্তবায়নে বেশ পিছিয়ে। চলমান ২৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবকটি প্রকল্পের কাজই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এসব প্রকল্প ঘিরে খরচ বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে সময়ও।
এ ছাড়া সমাপ্ত হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৬টি প্রকল্পের সময়সীমা প্রায় ১০ বছর অতিক্রম করেছে। ৯টি প্রকল্পে খরচ বেড়েছে সর্বোচ্চ ২৬০ শতাংশ এবং সময় বেড়েছে প্রায় ১০ বছর। দোহাজারি-কক্সবাজার প্রকল্পে শুরু থেকে এ পর্যন্ত ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। চলমান প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ না হওয়ায়, সমাপ্ত হওয়া প্রকল্পগুলোর যথাযথ সুফল মিলছে না। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রেলের কিছু প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছে। বলা হচ্ছে, দোহাজারি-কক্সবাজার প্রকল্পে ২ হাজার কোটি টাকা খরচ কমবে। কিন্তু এ প্রকল্পটি গ্রহণের শুরুতে মাত্র ১৮শ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। বর্তমানে এর ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। ২০০৭ সালের অক্টোবরে খুলনা রেলওয়ে স্টেশন ভবন নির্মাণ ও বেনাপোল স্টেশনের অপারেশনাল ক্যাপাসিটি বাড়ানো প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পের সময়সীমা ধরা হয়েছিল ২ বছর।
কিন্তু সেই প্রকল্প সমাপ্ত হয় ২০১৮ সালে, অর্থাৎ ৯ বছর সময় লেগেছে। আর ওই সময়ের মধ্যে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা প্রকৃত মূল্য ব্যয়ের চেয়ে ১১৩ শতাংশ বেশি। সূত্র জানায়, বর্তমানে ২৮টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। যার অধিকাংশ প্রকল্পে ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সময়ও বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সম্পন্ন করা ১৩টি প্রকল্পের মধ্যে ১২টিতেই নির্ধারিত সময়সীমার চেয়ে ৫ মাস থেকে প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত বেশি সময় লেগেছে। এর মধ্যে ৪টি প্রকল্প ছিল সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য। ৭টি প্রকল্পের ব্যয় ২৪.৭৩ শতাংশ থেকে ২৬০.৮১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
১৩টি প্রকল্পের মধ্যে ৫টি রেললাইন স্থাপন এবং স্টেশন নির্মাণের জন্য; ৫টি ভবিষ্যৎ প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই এবং সিগন্যাল স্থাপন, পুরোনো রেল কোচ মেরামত ও রেল সংস্কারের (রিফর্ম) জন্য ১টি করে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সময় ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পেছনে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা, প্রকল্পের নকশায় পরিবর্তন, কাজের পরিধি বৃদ্ধি এবং ক্রয় প্রক্রিয়ায় ‘রেট শিডিউল’ পরিবর্তনকে দায়ি করা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে রেলওয়ের ২৮টি চলমান প্রকল্পের অধিকাংশই সময়ের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে ৬টির বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রায় এক দশক ধরে পিছিয়ে আছে। ২০১০ সালের অক্টোবরে রেলওয়ে ৯৮২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ধলারচর পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুনে শেষ হয় এবং ১ হাজার ৭১৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল করিডোরের সক্ষমতা বাড়াতে লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত দ্বিতীয় ৮০ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেয়া হয়। এতে ব্যয় নির্ধারণ হয় ৫০১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১২ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এটি শেষ হয়েছিল ২০১৮ সালের অক্টোবরে। ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, যা প্রাথমিক বরাদ্দের চেয়ে ২৬০ শতাংশ বেশি।
২০১৬ সালের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে কোথায় কোথায় ওভারপাস বা আন্ডারপাস প্রয়োজন এমন স্পট চিহ্নিত করতে ৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। দেড় বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মেয়াদ আরও ১ বছর বাড়ানো হয়। এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হলে যা হয়, তাই হচ্ছে।
নিম্নমানের সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিকল্পনা, ঠিকাদারদের ক্ষমতার অভাব এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বল অবস্থাই এজন্য দায়ি। প্রকল্প গ্রহণ থেকে বাস্তবায়নে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া জমি অধিগ্রহণে দক্ষতার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। কারণ প্রকল্পের সময় বৃদ্ধি মানেই খরচ বৃদ্ধি। অন্যদিকে রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদ্যমান সমস্যা থেকে উত্তরণের সুপারিশ করেছে আইএমইডি। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রেলের সক্ষমতা বাড়ানো এবং রেল মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং জোরদার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সুপারিশে বলা হয়, প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের কার্যক্রম শেষ করতে হবে। প্রকল্পের অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করতে হবে এবং অনিস্পন্ন অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার জানান, কিছু প্রকল্পে খরচ বাড়ার সঙ্গে সময়ও বেড়েছে। আবার এমনও কিছু প্রকল্প রয়েছে, সময় বাড়লেও খরচ কমেছে। আখাউড়া-লাকসাম, দোহাজারি-কক্সবাজার প্রকল্পে সময় বাড়লেও খরচ কমেছে। আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা এবং দোহাজারি-কক্সবাজার প্রকল্পে এর প্রায় দ্বিগুণ (২ হাজার কোটি) টাকা কমেছে। তবে কোনো প্রকল্পে যখন সময় বাড়ে নানা কারণে খরচও বাড়ে। আমাদের পরিকল্পনা থাকে যথাসময়ে প্রকল্প শেষ করার। কিন্তু তা হয়ে উঠে না।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি