October 8, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, November 2nd, 2021, 8:39 pm

নথি গায়েব: চোর বিভীষণের মতো ঘরেই আছে

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

গায়েব হওয়ার মতো অলৌকিক ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা, শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ থেকে কেনাকাটার ১৭টি নথিসহ একটি ফাইল গায়েবের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। রোববার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ফাইল গায়েবের বিষয়টি ছিল সবার মুখে মুখে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চোখে-মুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ। সিআইডি সংশ্নিষ্ট শাখার সন্দেহভাজন ছয় কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়ার পর মন্ত্রণালয়জুড়ে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ‘ফাইল গায়েবের ঘটনায় কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়’- চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিবের এমন বক্তব্যের পর সবার মধ্যেই আতঙ্ক ভর করে।
করোনার সময় কেনাকাটায় দুর্নীতির জন্য আলোচনায় থাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচিবালয়ের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এর আগে ফাইল চুরির অভিযোগে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্তার পর নিরাপত্তা জোরদারে মন্ত্রণালয়জুড়ে সিসিটিভি স্থাপন করা হয়। আরোপ করা হয় কড়াকড়ি। বিশেষ করে সাংবাদিকদের প্রবেশে এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের প্রায়ই এড়িয়ে চলেন। এত নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরও ফাইল চুরির ঘটনাটি নজিরবিহীন বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। অনেকের মতে, বড় ধরনের দুর্নীতির তথ্য ধামাচাপা দিতে ফাইল গায়েব করা হয়েছে। অথবা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বন্দ্ব-গ্রুপিংয়ের কারণেও একজন আরেকজনকে ফাঁসাতে গিয়েও এমনটি করতে পারে।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের ভাষ্য, সরকারি ফাইল চুরি কিংবা গায়েবের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। এই ফাইলগুলো থাকলে যাদের অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তারাই এ ফাইল গায়েব করতে পারে। তদন্তকারী সংস্থা ও মন্ত্রণালয় যৌথভাবে চেষ্টা করে জড়িতের চিহ্নিত করা এবং ফাইলগুলো উদ্ধার করা উচিত।
তবে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ বলছে, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) কাজ শুরু করেছে। ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এরইমধ্যে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সন্দেহভাজন যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটিও কাজ শুরু করেছে। সুতরাং ঘটনার নেপথ্যে যে বা যারাই থাকুন না কেন, তা বেরিয়ে আসবে।
এদিকে, ছয় কর্মচারীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর সিআইডি যে তথ্য পেয়েছে তা পর্যালোচনা করে বলা যায়, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ না কেউ এই ফাইল চুরির সঙ্গে জড়িত। সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। কারণ, বাইরে থেকে কারও পক্ষে ওই কক্ষে প্রবেশ করার সুযোগ নেই। সুতরাং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া কারও পক্ষে ওই ফাইল চুরি করা প্রায় অসম্ভব। চোর বিভীষণের মতো আপন ঘরেই ঘাপটি মেরে আছে।
ফাইল গায়েবের ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিকেলে চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের উপসচিব (প্রকল্প বাস্তবায়ন-১ শাখা) এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব (ক্রয় ও সংগ্রহ-২) নাদিরা হায়দার রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি জিডি করেন। জিডিতে বলা হয়, চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের ক্রয়সংক্রান্ত শাখা-২-এর কম্পিউটার অপারেটর জোশেফ সরদার ও আয়েশা গত বুধবার কাজ শেষ করে ফাইলটি একটি কেবিনেটে রেখে যান। ওই ফাইলে ১৭টি নথি ছিল। পরদিন দুপুর ১২টার দিকে কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, ফাইলগুলো কেবিনেটে নেই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজসহ আরও কয়েকটি মেডিকেল কলেজের কেনাকাটা-সংক্রান্ত নথি, ইলেকট্রনিক ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ট্ক্রিনিং কর্মসূচি, নিপোর্ট অধিদপ্তরের কেনাকাটা, ট্রেনিং স্কুলের যানবাহন বরাদ্দ ও ক্রয়সংক্রান্ত নথি রয়েছে গায়েব হওয়া ফাইলে।
জানা যায়, চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) শাহাদৎ হোসাইনের কক্ষের লাগোয়া একটি কক্ষে বসেন ক্রয় ও সংগ্রহ শাখা-২-এর সাঁট মুদ্রাক্ষরিক ও কম্পিউটার অপারেটর মো. জোসেফ সরদার ও আয়েশা সিদ্দিকা। গায়েব হওয়া ১৭টি ফাইল ওই দুই কর্মীর কেবিনেটে ছিল। ওই কেবিনেটের চাবিও তাদের কাছে থাকে। তাহলে প্রশ্ন হলো, ফাইলগুলো গায়েব করল কে? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা মারফৎ জানা যায়, প্রাথমিকভাবে ওই দুই কর্মচারীকে দায়ী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বিশেষ করে বড় কোনো দুর্নীতির তথ্য ওই ফাইলে থাকার কারণে সেটি গায়েব করা হতে পারে। আবার চাবি থাকা দুই কর্মচারীকে ফাঁসানোর জন্য কেউ এ ঘটনা ঘটাতে পারে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই ঘটনাটির তদন্ত করা হচ্ছে।
চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. শাহাদৎ হোসাইন জানান, যে কেবিনেট থেকে ফাইলগুলো নেওয়া হয়েছে, সেটিতে কোনো ঘষামাজা নেই, দরজাও ভাঙা হয়নি। যে পয়েন্টে চাবি প্রবেশ করে সে জায়গাটিও স্বাভাবিক রয়েছে। এতে মনে হয়, হয়তো নকল চাবি অথবা অরজিনাল চাবি দিয়ে কেবিনেটটি খোলা হয়েছে। কারণ চাবি না থাকলে এত সূক্ষ্ণভাবে কেউ ফাইল নিতে পারত না। বাইরের কারও পক্ষে এ কাজ করা অসম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্র বলছে, মাস দেড়েক আগেও একই শাখা থেকে ফাইল গায়েবের ঘটনা ঘটে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কেনাকাটা-সংক্রান্ত ফাইল ছিল সেটি। গায়েব হওয়া ওই ফাইল খুঁজে দেওয়ার জন্য আয়েশা সিদ্দিকাকে চিঠি দেওয়া হয়; কিন্তু তিনি চিঠির জবাব দেননি। পরে তাকে শোকজ করা হয়। পরে আয়েশা সিদ্দিকা জানান, অন্তঃসত্ত্বা থাকার কারণে তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। তা ছাড়া হারানো ফাইল সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।
পরে নিয়ম অনুযায়ী, জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে আয়েশা সিদ্দিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াটি ধীর হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের ভাষ্য, সচিবালয়ের মতো সুরক্ষিত কার্যালয় থেকে ফাইল চুরির ঘটনা নজিরবিহীন। যে বা যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তারা সংশ্নিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া এটি করতে পারেনি। সুতরাং বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে ফাইলগুলো যেহেতু ক্রয়-সংক্রান্ত সেজন্য ওই ফাইলে কোনো দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আলামত রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
‘কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়’:ফাইল গায়েবের ঘটনায় তোলপাড়ের মধ্যে রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব আলী নূর বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন। নথি হারানোর বিষয়টি বৃহস্পতিবার জানার পরপরই পুলিশকে জানানো হয়। জিডিও করা হয়েছে। একই সঙ্গে সিআইডিকে বিষয়টি টেকওভার করতে বলা হয়। তাদের বলা হয়েছে, সন্দেহভাজন যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। তাতে কারও কোনো আপত্তি থাকবে না।
ফাইল গায়েবের ঘটনায় তদন্ত কমিটির সদস্য বাড়ানোর প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ফাইল গায়েবের পর শুক্রবার রাতে অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. শাহ্ আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আহসান কবীর এবং উপসচিব আবদুল কাদের। কমিটিতে বিভাগের উপসচিব মল্লিকা খাতুনতে যুক্ত করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই প্রতিবেদন পাওয়া যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
পুলিশ হেফাজতে ছয় কর্মচারী: ফাইল গায়েবের ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ছয় কর্মচারীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি। রোববার দুপুরে একটি মাইক্রোবাসে ওই ছয় কর্মচারীকে সচিবালয় থেকে সিআইডির কর্মকর্তারা মালিবাগের কার্যালয়ে নেন। এরপর তাদের দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রাত ৯টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ওই ছয় কর্মচারী সিআইডির হেফাজতে ছিলেন। তাদের আটক বা গ্রেপ্তারের ব্যাপারে তখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিআইডির হেফাজতে থাকা ছয় কর্মচারী হলেন- জোসেফ সরদার, আয়শা সিদ্দিকা, বাদল, বারী, মিন্টু ও ফয়সাল।
ছয়জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর সিআইডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্নিষ্ট কেউ ফাইল চুরির ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকতে পারে। এককভাবে বাইরের কারও পক্ষে এতগুলো ফাইল সরানো কঠিন।
এর আগে সকালে সচিবালয়ে গিয়ে তিন নম্বর ভবনের নিচতলার ২৪ নম্বর কক্ষ থেকে আলামত সংগ্রহ করেন সিআইডির সদস্যরা। সংস্থাটির ক্রাইম সিন ইউনিটের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট।
সিআইডির পুলিশ সুপার (এসপি) মো. কামরুজ্জামান বলেন, এ নিয়ে এখনও মামলা হয়নি। জিডি হয়েছে। মন্ত্রণালয়কেও ছায়া তদন্ত করতে বলা হয়েছে।