নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রায় দুই বছর ধরে চলছে করোনা অতিমারী। এর প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। বাদ নেই কর-রাজস্ব আহরণেও। তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আহরণ হয় মাত্র ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে করা হয় ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা। এটিও অর্জন হয়নি। চলতি অর্থবছরের জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। অতিমারীর অব্যাহত নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সেটি কতটুকু পূরণ হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ব্যক্ত করছেন অর্থনীতিবিদরা।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মোট আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরকে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, করোনার কারণে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের অবস্থা ভালো না। সরকার আয় বাড়াতে হন্যে হয়ে নতুন উপায় খুঁজছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ১৩ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে এক লাখ ২৬৭ কোটি টাকা। করোনার প্রভাব বিদ্যমান থাকলে রাজস্ব ঘাটতি আরো বাড়তে পারে।
করোনা এখনো পুরো বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর নতুন ভেরিয়েন্ট ‘ওমিক্রনে’ আক্রান্ত বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে এরইমধ্যে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এতে রপ্তানিতে নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমদানিতেও প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া প্রভাব পড়তে পারে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে। তবে এসব কিছু আপাতত অর্থ বিভাগকে ভাবাচ্ছে না। অন্তত আগামী অর্থবছরের মোট আয় এবং এনবিআরের প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রা দেখলে তা বোঝার উপায় নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবং অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের ভাষ্য, ‘বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি এখনো বিপর্যস্ত। নতুন করে ওমিক্রনের আঘাত থেকে তারা বাঁচতে নানা চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই আগামী দিনগুলো যে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না, তা বলা যায়। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরের জন্য এমন লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলে তা হবে ‘অবাস্তব’। এটা আদায় কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, এসব দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত থাকলে আমাদের রপ্তানি এবং প্রবৃদ্ধি দুটোতেই বড় প্রভাব পড়বে। ওমিক্রনের প্রভাবে দেশের অর্থনীতির কী অবস্থা হয় তা-ও ভাববার বিষয়। তা ছাড়া সারা বিশ্বে ওমিক্রনের ধাক্কা প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রায় কোনোভাবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাই আগামী বাজেটে উচ্চভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা পরিহার করা উচিত।’
দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবে বাড়াতে হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কর আহরণ আশানুরূপ বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় পরিচালনায় আর্থিক চাপে পড়ছে সরকার। কর আহরণ না বাড়ার পেছনে নানা ফ্যাক্টর কাজ করছে। দেশ স্বাধীন হলেও কর ব্যবস্থা এখনো ঔপনিবেশিক আদলে চলছে। এর পদে পদে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা বিরাজমান। একটি আয়কর আইন থাকলেও সেটি পাকিস্তান আমলের আইনের ছায়া অবলম্বনে প্রণীত। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দৃশ্যপটে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। পুরনো আইন বর্তমান সময়ের অধিক্ষেত্রের অনেক কিছুই কাভার করতে পারছে না। অনেক দিন কর ব্যবস্থায় অটোমেশন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। সেটি চলছে ঢিমেতালে। তদুপরি দেশে করসংক্রান্ত আইনি জটিলতা বিস্তর। চলমান মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে লাগছে দীর্ঘ সময়। আছে কর প্রশাসনের জনবলের ঘাটতি। বিপুল জনসংখ্যা অনুপাতে কর সেবাপ্রদানকারী লোকবল কম। যারা আছে তাদের দক্ষতা ঘাটতিও প্রবল। করজাল বাড়ছে না তেমন। ব্যবস্থার কারণে কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে প্রচুর। আবার কর আরোপণ মোটেই প্রগতিশীল নয়, বৈষম্যমূলক। ধনীরা কর দিচ্ছে মধ্যম আয়শ্রেণীর ব্যক্তিদের সমান। করযোগ্য আয় থাকলেও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান করের বাইরে রয়ে গেছে। এ ছাড়া অনেকেই কর দিলেও অনেক ক্ষেত্রে কর কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সেটি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে আশাব্যঞ্জকভাবে বাড়ছে না কর আহরণ।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় কর-জিডিপির গড় অনুপাত ৩৬ শতাংশের মতো। উদীয়মান এশীয় দেশগুলোর অনুপাতও গড়ে প্রায় ২৭ শতাংশ এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর গড় অনুপাত সাড়ে ১৮ শতাংশ। এমনকি সাব-সাহারা খ্যাত আফ্রিকার দেশগুলোর কর-জিডিপির গড় অনুপাত প্রায় ১৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি কর-জিডিপি অনুপাত নেপালের, প্রায় ১৯ শতাংশ। এরপর ভুটানের, ১৬ শতাংশ। ভারতের ১২ শতাংশ, শ্রীলংকার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ১১ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৯ দশমিক ৯ শতাংশ এবং মালদ্বীপের ৯ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশের ঘরে। উল্লিখিত দেশগুলোয় রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মূলে কাজ করছে আধুনিক, সহজ ও নির্বিঘœ কর ব্যবস্থা, দক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা এবং সর্বোপরি একটি সহায়ক রাজস্ব সংস্কৃতি। সুতরাং তাদের নীতি, পদক্ষেপ, রাজস্ব সংস্কৃতি আমাদের জন্য অনুসরণীয়।
এটি স্পষ্ট যে, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে কর-জিডিপি অনুপাত ১৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। অথচ উল্টো প্রবণতা হচ্ছে, করোনার কারণে সেটি বরং আগের চেয়ে কমছে। এটা আশঙ্কাজনক। এ অবস্থায় কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। এজন্য এনবিআরের অটোমেশনে গতি আনা খুব জরুরি। এটা কেবল কর ফাঁকি ধরতে সাহায্য করবে না, উপরন্তু নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা এবং এনবিআর ডাটাবেজের সঙ্গে কর প্রদানকারীর ব্যাংক হিসাবের যোগাযোগ তৈরিতে সহায়তা করবে। সংস্থাটি এরইমধ্যে অবশ্য কিছু সার্ভিস সেন্টার খুলেছে। এ ব্যাপারে করদাতাদের ওয়াকিবহাল করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজস্ব বিভাগে কর গোয়েন্দা সেলকেও আরো সক্ষম ও কার্যকর করা চাই। বিশ্বায়নের যুগে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে, প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে।
জানা যায়, এর মধ্যেই বহুপ্রতীক্ষিত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু করেছে সরকার। কিন্তু এর ফলে নানাভাবে হয়রানির মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। আয়কর আইন যুগোপযোগী এবং বাংলায় করাটা দীর্ঘদিনের দাবি। এটি এখন বাংলা ভাষায় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে খবর মিলছে। এটা হলে অনেক অস্পষ্টতা দূর হবে এবং জনগণও এ-সম্পর্কিত বিধিবিধান সহজেই জানতে পারবে, যা কর বাড়াতে সহায়ক। প্রতি বছরই করের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে তার প্রায় উল্টো। যারা নিয়মিতভাবে কর দেন, তাদের ওপরই দেয়া হয় বাড়তি চাপ। কয়েক বছর ধরে নতুন করদাতা নিবন্ধন বাড়ানোর হিসাব দেয়া হলেও বাস্তবে সংখ্যাটি খুবই কম। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক বা করপোরেট কর পাওয়া যায়, এমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও তেমন বাড়েনি। ফলে বাড়তি চাপ নিতে হয় মূলত নিয়মিত সৎ করদাতা বিশেষভাবে পেশাজীবী সম্প্রদায় ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে। এটা হতাশাজনক। বড় শহরগুলোয় কর দেয়ার প্রবণতা বেশি হলেও মফস্বল পর্যায়ের অনেক সচ্ছল ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান করের আওতায় নেই।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি