October 12, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, June 6th, 2022, 1:20 pm

নিজেদের প্রচেষ্টায় স্বাবলম্বী হচ্ছে শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা

চাকরির বাজারে বিক্রি না হয়ে নিজেদের কর্মসংস্থান নিজেরাই বেছে নিচ্ছেন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা। করোনার প্রায় দুই বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় অবসর সময়কে কাজে লাগিয়েছেন এই উঠতি উদ্যোক্তারা। পর্যাপ্ত সময়, স্বল্প মূলধন, অনলাইন নির্ভর বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করেই তরুণ উদ্যোক্তারা গ্রাহকদের সেবার মাধ্যমে নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

এদের মধ্যে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের একটি অংশ রয়েছে। উদ্যোক্তা হওয়ার মাধ্যমে তারা নিজ নিজ কর্মস্থানে নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

চাঁদপুরের ছেলে মো. রাকিবুজ্জামান পড়াশোনা করছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সেমিস্টারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর দেড় মাসের মাথায় করোনায় বন্ধ হয়ে যায় তার নিজ বিদ্যাপীঠ।পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার পর বছরের প্রথম দিন শাবিপ্রবির গেইটে চালু করেন ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট ‘দ্য বাইট ক্যাভ’।

শিক্ষার্থী মো. রাকিবুজ্জামান বলেন, এসএসসি পাস করার পর ১৭ বছর বয়সে মাথায় শুধু ঘুরপাক খেতে থাকে পড়াশোনার পাশাপাশি যেভাবেই হোক স্বনির্ভর হতে হবে। আর তার জন্য চাই পুঁজি। কলেজের পুরো সময়টা চলে গেলো কিছুটা পুঁজি জমাতে। ভার্সিটিতে পা রাখতে না রাখতেই ‘করোনা’র মধ্যে পড়লাম। করোনাকালীন যেই সময়টা বাড়িতে ছিলাম, সেই সময়টা কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম। রান্না-বান্নার প্রতি আমার সব সময়ই একটা আগ্রহ ছিল এবং বাসায় প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের রান্না করে আম্মুকে টেস্ট করাতাম। এই আগ্রহ থেকেই ভাবলাম ভার্সিটি গেইটে রেস্টুরেন্ট দেয়ার কথা।

তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি আমি যেই ক্ষেত্রেই কাজ করতে যাই বা ব্যবসা দাঁড় করাতে যাই না কেন, প্রথমে সেই সেক্টরে আমাকে নিজের প্রবেশ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। বাড়িতে করোনাকালীন সময়ে সন্ধ্যার পরের সময়টা এক বন্ধুর রেস্টুরেন্টে কাটাতাম। প্রায় ছয় মাস সেখানে আমি সময় দিলাম শুধু নিজের অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য। অবশেষে অনেক বাধা বিপত্তির পর ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে আমি ‘দ্য বাইট ক্যাভ’ রেস্টুরেন্টটি চালু করেছি। আমার সঙ্গে আমারই ডিপার্টমেন্টের বন্ধু মো. মহিউল ইসলাম যুক্ত রয়েছে।

মো.রাকিবুজ্জামান বলেন, আমার শুরু থেকে একটাই লক্ষ্য ছিল-স্টুডেন্ট ফ্রেন্ডলি বাজেটে কোয়ালিটিসম্পন্ন খাবার সরবরাহ করা। আমার রেস্টুরেন্টের কাস্টমারদের একটা বড় অংশ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। খাবারের গুণগত মানের দিক ভালো হওয়ার কারণে খুব অল্প দিনেই ‘দ্য বাইট ক্যাভ’ সবার আস্থা অর্জন করেছে। আমাদের অনলাইন পেইজ দ্য বাইট ক্যাভ ও ফুড পান্ডা অ্যাপের মাধ্যমে আমাদের রেস্টুরেন্টের সেবা পুরো সিলেট শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার স্বপ্ন আছে দ্য বাইট ক্যাভের আরও একটি ব্রাঞ্চ চালু করার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আদিবা মালিহা পড়াশোনার পাশাপাশি সময় দিচ্ছেন মেয়েদের গহনার দিকে।

অনলাইনে উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, স্বপ্ন দেখা,স্বপ্নের পিছু ছুটে চলা এবং স্বপ্ন পূরণ- উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে এই ধারাবাহিকতা আমাকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে। বেশ আগে থেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে গেঁথে ছিল। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করে রাখি কিছু একটা করব। এরপর করোনা আর লকডাউনের সময়টাতে যখন ঘরবন্দি হয়ে আছি, সেই সময়টায় হুট করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা ফেসবুক পেইজ খুলে ফেলি। গহনার প্রতি ভালো লাগা থেকেই নিজের শখটাকে কাজে লাগিয়েছি। সেই থেকেই ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি জুয়েলারি নিয়ে‘ফসফেনস’এর যাত্রা শুরু হয়। বিজনেসের শুরু থেকেই বাবা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া অসাধারণ সাপোর্ট এবং একইসঙ্গে আশেপাশের মানুষ থেকেও বেশ ভালো সাড়া পেয়েছি যা আমার ছোট্ট পেইজটাকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। খুবই ক্ষুদ্র অংকের টাকা দিয়ে অল্প অল্প করে ফসফেনসকে দাঁড় করিয়েছি। আজ প্রায় দুই বছরের বেশি সময় পর আমার ছোট্ট পেইজে প্রায় ৯ হাজার ৫০০ এর বেশি ফলোয়ার যুক্ত হয়েছে। স্বপ্ন দেখি আকাশছোঁয়ার- অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার ‘ফসফেনস’কে একটি নামকরা ব্র্যান্ডে পরিণত করার এবং একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার।

রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অনুসূয়া রায় শখের বসে হ্যান্ড পেইন্টের কাজ করেন। করোনাকালীন ছুটিতে শখের কাজ করতে করতে উদ্যোক্তা বনে গেছেন। তিনি বলেন, করোনাকালীন সময় আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবাই বাড়িতে থেকে অনেকেই নিজের সামর্থে অর্থ উপার্জন করেছি নিজেদের হাতে তৈরি করা হ্যান্ডপেইন্টেড শাড়ি, থ্রি পিচ, বিভিন্ন রকমের গহনা এসব বানিয়ে। আমিও তাদের মাঝেই একজন। ‘কল্পনার রঙ’ পেইজটি নিজের শখের বসে খোলা হলেও আমার শখের পাশাপাশি আমার সামান্য আয় হচ্ছে এবং আমার অবসর সময়টাও কাজে লাগছে। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখে হ্যান্ড পেইন্টের কাজের চাহিদা বেশি পড়ে। অনলাইনসহ পরিচিতজনরা বিভিন্নভাবে কাজের অর্ডার দেন। পড়াশোনার পাশাপাশি এভাবে কাজ করতে পারাটা একধরনের আনন্দ কাজ করে। আশা করবো ভবিষ্যতে আমার এই ক্ষুদ্র পেইজটি আমার জীবনে অনেক বড় একটা ভূমিকা পালন করবে এবং স্বাবলম্বী হতে পারবো।

সিলেট শহরে টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ দই, মিষ্টি ও ঘি এর যোগান দিচ্ছেন শাবিপ্রবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী জয় চন্দ্র ঘোষ। মূলত টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায় বাবার মিষ্টির দোকানের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন দিয়ে সিলেট শহরে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলা শুরু। প্রথম দিকে অনলাইনে যাত্রা শুরু হলেও নগরীর সুবিদবাজারে নিজস্ব আউটলেট তাকে দিয়েছে আলাদা পরিচয়।

জয় চন্দ্র ঘোষ বলেন, আমার পূর্বপুরুষেরা কবে থেকে দধি বানাচ্ছে তা আমাদের কারও জানা নেই। আমার বাবা, দাদা, আমার পরদাদা,আমার বাবার পরদাদা সবাই দই মিষ্টি বানিয়ে আসছে। সেই হিসেবে এটাকে শিল্পও বলা যেতে পারে। আধুনিক শিল্পবিপ্লবের ফলে গ্রামবাংলার অনেক শিল্পই হারিয়ে গেছে। যদি ভালো পরিচর্চা না পায় তবে অন্য সবের মতো এটাও হয়ত হারিয়ে যাবে। তাই পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি আর পেশা হিসেবে যা কিছুই করি না কেন,আমি আমার এই পারিবারিক ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করতে চাই। ওই চিন্তা থেকেই শিক্ষার্থী হিসেবে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করা।

তিনি বলেন, আমার বাবা ব্যবসায়ী হলেও পরিবারের কেউই ব্যবসা পছন্দ করে না। তাই পরিবারের কাউকে না জানিয়ে ২০১৬ সালে মেসের একজন বড় ভাইকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। টাঙ্গাইলের দই মিষ্টি রসমালাই ঘি নিয়ে ‘সুইট হাট’নামে অনলাইনে একটা পেইজের মাধ্যমে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। বছর খানেক অনলাইনে বিজনেস করার পর আমরা সিলেটের সুবিদবাজারে আমদের প্রথম আউটলেট দেই। তারপরের বছর সিলেটের শিবগঞ্জে আমাদের দ্বিতীয় শোরুম খুলি। করোনার কারণে আমাদের ব্যবসার প্রচুর ক্ষতি হয়। আমাদের দ্বিতীয় শোরুমটি বন্ধ হয়ে যায়। করোনা পরবর্তী আমরা আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছি। আমাদের আরেকটা নতুন শোরুম সিলেটের ঈদগাহতে চালু হচ্ছে। আমাদের ইচ্ছা আছে টাঙ্গাইলের মিষ্টির ঐতিহ্য সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার।

বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর ২য় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী নিলুফা আক্তার নীলার রয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শাড়ি ও পাঞ্জাবির ব্যবসা। প্রয়োজনের তাগিদেই এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছে আসলে শখ থেকে হয়নি বরং প্রয়োজন থেকে শুরু হয়েছে। আমি আমার পড়াশোনার জন্য পরিবার থেকে বাইরে থাকি। সিলেটে টিউশনি করে আমি পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারকে সাপোর্ট করে থাকি।

নিলুফা আক্তার নীলা বলেন, যখন করোনা মহামারির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায় তখনই প্রয়োজনবোধ করি ভিন্ন কিছু করতে হবে। লকডাউন শুরু হয়ে যায় তখন আমার ইচ্ছে থাকলেও কাজ শুরু করতে পারিনি। ২০২১ সালে আমার স্নাতক শেষ করে ঢাকায় আসা হয়, পরিবারের সদস্য হিসেবে ভাবির সঙ্গে আমার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে তিনি আমাকে ফেসবুকে একটা পেইজ খোলার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই আমার ‘অবসরে সায়র’ এর যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে কুমিল্লার খাদি আর সিলেটের চা পাতা দিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলেও এখন গ্রাহকদের কাছে রাজশাহীর সিল্ক, নারায়ণগঞ্জের জামদানি, সিলেটের মণিপুরী, টাঙ্গাইলের তাঁতের কাপড়সহ বিভিন্ন নকশার পাঞ্জাবি বিক্রি করা হয়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত এক লাখ টাকার বেশি বিক্রি হয়।

বর্তমানে ‘অবসরে সায়র’ গ্রুপের সদস্য এক হাজারের বেশি হলেও প্রতিদিনই বাড়ছে। পরিচিত সদস্যদের মাঝে ভালো কিছু সরবরাহ করতে পারি বলে গ্রাহক চাহিদায় সন্তুষ্টি থাকে। দেশীয় পোশাক আমাদের ঐতিহ্য। ঐতিহ্যকে ধারণ করে মানসম্পন্ন ও রুচিসম্মত পোশাক সবার কাছে পৌঁছে দেয়াই আমার উদ্দেশ্য।

এই বিষয়ে শাবিপ্রবির স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক আগ থেকেই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তবে বর্তমানে অনলাইন নির্ভর বিজ্ঞাপন এবং করোনাকালীন অবসর সময়ের পর বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মগুলোতে অনেকটা বেশি দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রযুক্তিগত ছোঁয়া ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে বড় উদ্যোক্তা হতে সাহস যোগাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি এই ধরনের চর্চা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের নতুন পরিবেশ তৈরি করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক আমিনা পারভীন বলেন, ডিজিটাল এই যুগে অনলাইন মাধ্যম ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মাঝে বাড়তি সুযোগ সুবিধার বিস্তার ঘটিয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা এই বিষয়ে পিছিয়ে নেই। প্রযুক্তির ব্যবহার এইসব ছোটো ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য আশীর্বাদ। এছাড়াও করোনার দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের কর্মের ক্ষেত্রেও আলাদা চিন্তার জায়গা তৈরি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখছে।

—ইউএনবি