October 13, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, February 19th, 2022, 8:48 pm

নিত্যপণ্যের বাজারে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা, নেই শক্তিশালী তদারকি

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা যেন নিত্যসঙ্গী। প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম দ্রুত গতিতে বাড়ছে। ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষকরে নিম্নআয়ের মানুষের জীবন ধারণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে বাজারে চাল, ডাল, পেঁয়াজ ও ভোজ্য তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। বাজারে সব ধরনের চালের দামই গত কয়েক সপ্তাহে বেড়েছে। পেঁয়াজের দাম গত দুই সপ্তাহে দ্বিগুণ বেড়েছে। এ ছাড়া মসুর ডাল, আদা, চিনি, ভোজ্য তেল-সব কিছুরই দাম ঊর্ধ্বমুখী। এমনকি সবজি, মুরগি এবং মুরগির ডিমের দামও বেড়েছে। এদিকে বাসাবাড়িতে তীব্র গ্যাস সংকট মুহূর্তেও বেড়েছে গ্যাসের দাম। আবার পানির দাম বাড়ানোরও প্রস্তাব করেছে ওয়াসা। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
শুধু কাঁচাবাজারেরই এই অবস্থা, আগুন বিরাজ করছে পাকা বাজারেও। আদা, রসুন, পেঁয়াজ, তেল এবং চিনি সবকিছুরই দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। বাজার ব্যবস্থায় এখনো এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা কাজ করছে বলে অভিযোগ আছে। অর্থনীতির সাধারণ সূত্রগুলোও এখানে অচল। সুযোগ পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
ভোজ্যতেলের দাম যে অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে এবং তা আছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে তা উপলব্ধি করতে পারছে সরকারও। ভোজ্যতেলের দাম যৌক্তিক ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রাণান্ত চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন। তিনি বলেন, প্রয়োজনে ই-কমার্স চালুর পরিকল্পনাও আছে। ই-কমার্সের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে ঘরে ঘরে পণ্য পৌঁছে দেয়া যায় কিনা ভাবছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। শিগগিরই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হতে পারে। বাজার সহনীয় রাখতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনাও করা হচ্ছে। টিসিবিও এ ক্ষেত্রে কাজ করছে।
ভোজ্যতেল যে আমদানি হচ্ছে না এমন কিন্তু নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত তিন অর্থবছরে প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকার ভোজ্যতেল ও তেলবীজ আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণটি আমদানি হয়েছে ২০ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকার। আগের দুই অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৯ হাজার ৯২৪ কোটি ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৮ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্যপণ্য আমদানির একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছে। সংস্থাটির ২০১৫-১৮ সময়ের এ তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক বলছে, এ চার বছরে গড়ে প্রতি বছর ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। মুদ্রার বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে নিলে মোট ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে মোট আমদানির বড় অংশই ছিল ভোজ্যতেলকেন্দ্রিক। এ আমদানির ১৮ শতাংশ পাম অয়েল, সয়াবিন তেল ১১ শতাংশ, সয়াবিন ৬ শতাংশ ও সয়াবিনের খৈল ২ শতাংশ। অর্থাৎ মোট আমদানির প্রায় ৩৭ শতাংশই ব্যয় হয়েছে ভোজ্যতেলে।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের পণ্যবাজার আত্মনির্ভরশীল নয়। মোটামুটি সিংহভাগ পণ্য আমদানি করতে হয়। তাই যে কোনো পণ্যের দামের ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক দেশের পরিস্থিতির পাশাপাশি বুকিং রেটের ওপর ভরসা করতে হয় এ দেশের ভোক্তাদের। বাংলাদেশের বাজারে মূলত ভারত-মিয়ানমার ও চীন থেকে পেঁয়াজ-আদা-রসুন, এবং ব্রাজিল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে ভোজ্য তেল ও চিনি আমদানি করা হয়। এই সবকটি পণ্যের দামই এখন বাড়তি। পেঁয়াজের দাম গত দুই সপ্তাহে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাজারে কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে পেঁয়াজের দাম। অথচ এ বছর পেঁয়াজ উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে, আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে ছয় লাখ টন। বন্ধ নেই আমদানিও। এর জন্য মূলত সিন্ডিকেটদের হাত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের বাজার ব্যবস্থা এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটদের হাতেই বলতে গেলে জিম্মি।
সিন্ডিকেটদের কারসাজিতে আমদানিকারক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে তা কমে না। এ ক্ষেত্রে বাজার তদারকিতে বিরাট ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিগত কয়েক মাস ধরেই ভোজ্য তেলের বাজারে ঊর্ধ্বগতি বিরাজমান। সম্প্রতি তা আবার বেড়েছে। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান অজুহাত আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট বেড়ে যাওয়া। এ বছর ধান উৎপাদনেও রেকর্ড হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে চালের দাম কমেছে ২৪ শতাংশ। কিন্তু আমাদের বাজারে এসবের কোনো প্রভাব নেই। বরং উল্টো চিত্রটাই দেখা যায়। সম্প্রতি আবার বেড়েছে চালের দাম। বাজারে এখন শীতকালীন সবজির যথেষ্ট সরবারহ রয়েছে। কিন্তু দাম কমার পরিবর্তে বরং বেড়েছে। মুরগি, ডিমের দামও বেড়েছে বহুলাংশে। এমন বাজার পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে রীতিমতো নাভিশ্বাস চরমে উঠে গেছে। পারৎপক্ষে, বারবার হঠাৎ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির মূলে রয়েছে অসাধু সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজি।
গত দু’ বছর দেশ করোনার তান্ডবে ছিল বিপর্যস্ত। দেশের এই বিপর্যস্ত অবস্থারও সুযোগ নিয়ে একটা অসাধু চক্র দেশের নিত্যপণ্যের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। সাধারণ মানুষকে বিপদে ঠেলে দিয়ে তারা তাদের পকেট ভারি করে। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক পণ্য মূল্য প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনার কারণে গত বছর দেশে সব ধরনের চালের দাম আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে গড়ে ২০ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৭ শতাংশ বেড়েছে স্বর্ণা পারিজাসহ মোটা চালের দাম। মিনিকেট ও নাজিরশাইলসহ সরু চালের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত।
এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। প্রতিনিয়ত দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং সে অনুপাতে নিত্যপণ্যের চাহিদার মধ্যেও এক ধরণের তারতম্য দেখা দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি হিসাবেই যেহেতু জনসংখ্যা ১৮ কোটি তাই ভোগ্যপণ্যের চাহিদার হিসাব করতে হবে এর ভিত্তিতে। এর সঙ্গে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে পণ্যের চাহিদা নিরূপণ করা হচ্ছে সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যা ধরে। এখানেই ভোগ্যপণ্যের চাহিদার বাইরে থাকছে দেড় কোটির বেশি মানুষ। ফলে উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত পণ্য থাকলেও বাস্তবে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। জনসংখ্যার তুলনায় চাহিদায় বরং ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এতে চাহিদার সংকট হওয়ায় পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে নিয়মিত আদমশুমারি হওয়া জরুরী বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ভোগ্যপণ্যের যে চাহিদা নিরূপণ করে পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে, তার সঙ্গে বাজারের বাস্তবতার মিল থাকছে না। এতে ফিরছে না বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা। স্বাভাবিকভাইে উৎপাদন মৌসুমেও বিভিন্ন পণ্যের দাম থাকছে বেশ চড়া। ভোক্তাদের পকেট থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ চলে যাচ্ছে ভোগ্যপণ্য কিনতে। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেসামাল থাকায় সরকারকে পড়তে হচ্ছে বিব্রতকর অবস্থায়।