নিজস্ব প্রতিবেদক:
নৌপথকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে বাল্কহেড। সন্ধ্যার পর থেকে নৌপথে বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও অবৈধ বাল্কহেড চালক ও মালিকরা তা মানছে না। বালুবাহী ওসব নৌযান বেপরোয়াভাবে চলাচল করায় নৌপথে প্রায়ই দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রেই ওসব বাল্কহেডে সিগন্যাল বাতি থাকে না। মূলত চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় আলো নিভিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছে ওসব বাল্কহেড। ফলে নৌপথে রাতে বাল্কহেড নীরব ঘাতক হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো স্থানে নৌপুলিশ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই বাল্কহেড রাতের বেলা চলাচল করছে। নৌপথ এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিআইডব্লিউটিএ, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, নৌপুলিশ এবং নৌযান মালিকদের অবহেলার কারণে দেশের নৌপথ এখনো নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে কারোর টনক নড়ে না। বালুবোঝাই বাল্কহেডে কোনো আলোর ব্যবস্থা থাকে না। মাত্র এক থেকে দেড় ফুট উপরিভাগে থাকলেও ওই নৌযানের বেশিরভাগই থাকে পানির নিচে। কখনো কখনো বাল্কহেডের ওপর দিয়ে পানি বয়ে যায়। তাই এটি রাতের বেলায় চলাচলের উপযোগী নয়। এ ছাড়া অধিকাংশ বালুবাহী নৌযানের অনুমোদিত নকশা, বার্ষিক ফিটনেস সনদ (সার্ভে) ও নিবন্ধন নেই। দেশে ৪ হাজার ৭০০টি বাল্কহেডের নিবন্ধন থাকলেও চলছে প্রায় ১১ হাজার। আর বেশিরভাগ বাল্কহেডের মাস্টার অদক্ষ।
সূত্র জানায়, বিগত ২০২২ সালে দেশে বাল্কহেডের কারণে ৩৬টি নৌ-দুর্ঘটনার অর্ধেকের বেশি হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত দেশে ৪৯টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮ জন, আহত ৭ জন এবং নিখোঁজ ১২ জন। শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত ছয় মাসে নৌপথে ৫৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৭ জন। আহত হয়েছেন ৫০ জন, নিখোঁজ রয়েছেন ৩৪ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের জীবিত খুঁজে পাওয়ার নজির নেই। এই হিসেবে ছয় মাসে নিহতের সংখ্যা হবে ৯১ জন। জানুয়ারিতে পাঁচটি নৌ দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত, ৫ জন আহত ও ৬ জন নিখোঁজ হয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ১৩টি নৌ দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত, ২৪ জন আহত ও ১৪ জন নিখোঁজ হন। মার্চে সাতটি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ৯ ও ৫। এ মাসে নৌ দুর্ঘটনায় কেউ নিখোঁজ হননি। এপ্রিলে ৯টি দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত হয়েছেন। আহত ও নিখোঁজের সংখ্যা যথাক্রমে ৬ ও ৩। মে মাসে সাতটি দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত, ৩ জন আহত ও ৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন। জুন মাসে নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৩টি। এতে নিহত, আহত ও নিখোঁজ হয়েছেন যথাক্রমে ১০, ৭ ও ৮ জন। সূত্র আরো জানায়, সন্ধ্যার পর থেকে চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় বাল্কহেড চালকরা আলো নিভিয়ে চলাচল করে। এ কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে।
তবে পথে পথে নৌ ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা টহল দিয়ে ওসব বাল্কহেড থেকে চাঁদা নেয়। বাল্কহেড চলাচলে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকা গাবতলীর আমিনবাজার পর্যন্ত নৌপুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। না দিলে অহেতুক হয়রানি করে। সবচেয়ে বেশি হয়রানি করা হয় সদরঘাট নৌ থানা পুলিশ। যেসব স্পটে নৌপুলিশকে চাঁদা দিতে হয় তা হলো মুন্সীগঞ্জ, বক্তাবলি, পাগলা, পোস্তগোলা, সদরঘাট, বরিসুর ও বছিলা। পথে পথে বিভিন্ন হারে নৌ পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। নানা অজুহাতে নৌযান আটকিয়েও মোটা অংকের টাকা নিয়ে থাকে। আর বিআইডব্লিউটিএর লোকজন কাগজপত্র দেখার নামে মাসোহারা নেয়।
এদিকে বাল্কহেড চালক সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, রাতে বাল্কহেড চলাচল করে না। আর ইচ্ছে করলেই জাহাজ এক জায়গায় ঢুকিয়ে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। যেমন মাওয়া থেকে ছেড়ে আসা একটি বাল্কহেড এখলাসপুর ঘাট ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারবে না। মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা জাহাজটি ধর্মগঞ্জ এসে ঘাট দেবে। আবার মোহনপুর থেকে ছেড়ে আসা জাহাজটি মুন্সীগঞ্জের ঘাট ধরতে পারবে। অনেক সময় কোনো জাহাজ আসা-যাওয়ায় এক-দেড় ঘণ্টার তারতম্য ঘটতে পারে। এ কারণে একটু রাত হয়ে যায়। কিন্তু বাল্কহেড রাতে চলাচল করে না।
অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) মো. জয়নাল আবেদীন জানান, বাল্কহেড রাতের বেলায় চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ। এর রুট পারমিট বিআইডব্লিউটিএ দেয় না। এর তদারকি করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। তারা বাল্কহেডের সার্ভে ও ফিটনেস সনদ দেয়। আমরা বিভিন্ন সময়ে রাতের বেলায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি। সম্প্রতি সদরঘাটে দুটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। এ ছাড়া নৌ পুলিশ কাজ করছে। আমরা বাল্কহেড মালিক-চালক সমিতির নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করেছি। তাদের বারবার বলা হয়েছে, বাল্কহেড রাতের বেলায় চলাচলের উপযোগী নয়। তারপরও অবাধে এগুলো চলাচল করছে।
বালুবাহী বাল্কহেড ও ট্রলারের বিরুদ্ধে মেরিন কোর্ট আইনে মামলা করা হবে। রাতে যাতে বাল্কহেড চলতে না পারে, সেজন্য অভিযান জোরদার করা হচ্ছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট অফিসারদের চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নৌ পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম জানান, নৌপথ নিরাপদ রাখতে নৌ পুলিশ সব সময় কাজ করছে। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সম্প্রতি চাঁদপুরের মেঘনায় অভিযান চালিয়ে ২৮টি বালুবাহী বাল্কহেড ও ৩টি ড্রেজার জব্দ করেছে নৌ পুলিশ। এ ঘটনায় আটক করা হয়েছে ৬২ শ্রমিককে। অভিযান অব্যাহত থাকবে। যদি কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নৌপথে বালুবাহী বাল্কহেডে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আরও পড়ুন
রাতের মধ্যে ৭০-৮০% ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু হবে: আইএসপিএবি
সীমিত পরিসরে খুলেছে অফিস-ব্যাংক; রাজধানীতে যানজট
নেপালে রানওয়ে থেকে ছিটকে বিমান বিধ্বস্ত, ১৮ যাত্রীর মৃত্যু