October 13, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, June 2nd, 2022, 9:37 pm

পণ্য আমদানিতে ভারতনির্ভরতা বাড়ছে

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

পণ্য আমদানিতে ভারতনির্ভরতা বাড়ছে। খাদ্যশস্য ও শিল্প খাতের কাঁচামালের আমদানিতে বাংলাদেশ আগে অনেকাংশেই ভারতনির্ভর থাকলেও গত কয়েক বছরে তা অনেক কমে এসেছিল। কিন্তু বর্তমানে আবারো পণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। মূলত চলমান ইউক্রেন সঙ্কটের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ কভিডের অভিঘাত সামলে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেন-রাশিয়া চলমান যুদ্ধ বৈশ্বিক বাণিজ্য খাতে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি করেছে। ভেঙে পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সরবরাহ চেইন। কয়েকটি দেশ থেকে পণ্য আমদানি করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া জাহাজ ও কনটেইনার সঙ্কটের পাশাপাশি পরিবহন ভাড়াও অনেক বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশী আমদানিকারকদের প্রতিবেশী ভারতের দিকেই বেশি ঝুঁকতে হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত এবং আমদানি বাণিজ্য সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভারত থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮৮৯ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। ওসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে তুলা, খাদ্যশস্য, মোটরযান ও যানবাহনের যন্ত্রাংশ, মূলধনি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, খনিজ পণ্য ও জ¦ালানি, অর্গানিক কেমিক্যাল, চা-কফি-মসলা, ট্যানিং ও ডায়িং, পিগমেন্ট, রঙ, পুটি, কালি, লৌহ ও ইস্পাত, খাদ্য শিল্পের উপজাত ও পশুখাদ্য এবং চিনি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে তুলা, খাদ্যশস্য, লৌহ ও ইস্পাত এবং চিনির মতো পণ্যে দেশটির ওপর আমদানিনির্ভরতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে দেশে আমদানীকৃত গমের ৭০-৮০ শতাংশ, চিনির ৯০ ও চালের ৭০-৮০ শতাংশ ভারত থেকে আসছে। তাছাড়া ভারত থেকে আমদানীকৃত পেঁয়াজেরও শতভাগই আসছে।
সূত্র জানায়, একসময় চাল ও গমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আমদানির বাজার পুরোটাই ভারতনির্ভর ছিল। ফলে একক একটি দেশের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে দেশে পণ্যের বাজার প্রায়ই অস্থিতিশীল হয়ে উঠতো। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ আমদানির উৎসে বৈচিত্র্য এনেছিল। চাল আমদানির উৎস দেশের তালিকায় ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারের মতো দেশ। কিন্তু যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে পরিবহন ব্যয় কমাতে পণ্যটির আমদানিকারকরা এখন আবারো ভারতনির্ভর হয়ে পড়ছে। বর্তমানে দেশে আমদানীকৃত চালের সিংহভাগই ভারত থেকে আসছে। তাছাড়া দেশে বার্ষিক গমের চাহিদা ৭৫ লাখ টন। পণ্যটি আমদানিতে বাংলাদেশের নির্ভরতা রাশিয়া, ইউক্রেন ও কানাডার ওপর সবচেয়ে বেশি ছিল। তার মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকেই ৪৫ শতাংশ আসতো। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এখন দুটি দেশ থেকেই আমদানি একপ্রকার বন্ধ। কানাডায়ও সর্বশেষ মৌসুমে খরার কারণে পণ্যটির উৎপাদন ভালো হয়নি। এমন অবস্থায় দেশে গমের শীর্ষ সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে ভারত। আর চিনি আমদানিতে অনেক আগে থেকেই ভারতনির্ভর বাংলাদেশ। বর্তমান পরিস্থিতি ওই নির্ভরতা আরো বাড়িয়েছে। আর বস্ত্র ও পোশাক খাতের অপরিহার্য কাঁচামাল তুলা। বাংলাদেশকে প্রতি বছরই পণ্যটি ৮০-৮৫ লাখ বেল আমদানি করতে হয়। আগেও দেশে আমদানীকৃত তুলার প্রধান উৎস ছিল ভারত। পণ্যটির মোট আমদানির প্রায় অর্ধেকই ভারত থেকে আসতো। তবে গত কয়েক বছরে ওই স্থান নিয়েছিল আফ্রিকার দেশগুলো। পণ্যটির আমদানিতে ভারতের অবদান নেমে এসেছিল ২০ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু কভিডকাল থেকেই জাহাজ ও কনটেইনার সঙ্কটে ভুগছে বৈশ্বিক বাণিজ্য খাত। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ওই পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে উঠেছে। ফলে সঙ্কট মোকাবেলায় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আবারো তুলার জন্য বাংলাদেশী আমদানিকারকদের ভারতের দিকেই ঝুঁকতে হয়েছে। যদিও যুদ্ধ শুরুর আগে ২০২১ সালেই দেশে ভারত থেকে তুলা আমদানি বাড়তে দেখা যায়। গত বছর দেশে আমদানীকৃত তুলার ২৯ শতাংশ ভারত থেকে এসেছিল। চলতি বছর তাতে দেশটির অংশ আরো বাড়তে যাচ্ছে। সুতার ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি। গত বছর দেশে আমদানি হওয়া সুতার ৮৪ শতাংশ ভারত থেকে এসেছে। সুতা আমদানিতে ভারতনির্ভরতা আরো বাড়তে পারে।
সূত্র আরো জানায়, ভারত থেকে যে পণ্যই আমদানি করা হোক তা বাংলাদেশের স্বার্থেই করা হয়। কারণ ভারত থেকে সস্তায় ও প্রয়োজনমাফিক পণ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া বাণিজ্যিক আলোচনার ক্ষেত্রেও এক ধরনের ভাষাগত সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু ওই দেশটি থেকে মাঝেমধ্যে কোনো কোনো পণ্যের সরবরাহ একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছে। প্রায় ৬ গুণ বেড়েছে জাহাজের ভাড়া। তুলা আমদানি করতে গেলে দেখা গেল পণ্যের দামের চেয়ে পরিবহন ব্যয় বেশি। সেজন্য আমদানিকারকরা এখন বাধ্য হয়েই ভারতের দিকে ঝুঁকেছে।
এদিকে শিল্পোদ্যোক্তা ও আমদানিকারকদের মতে, ভারত থেকে আমদানি বৃদ্ধির কারণ ছিল তাড়াতাড়ি পণ্য সড়কপথে নিয়ে আসা। চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচলে সঙ্কট, শিপিং চার্জের কারণে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে ভারত থেকে পণ্য আমদানি বাড়ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী স্থলবন্দরগুলো দিয়ে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পণ্য আসছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় সুবিধা হচ্ছে পরিবহন খরচ কমে যাওয়া। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে পণ্য জাহাজীকরণে সবচেয়ে বেশি সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। তাছাড়া ভারতের ভোগ্যপণ্য দামে কিছুটা বেশি হলেও পরিবহন খরচের কারণে তুলনামূলক বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়েও কম দামে বিপণন করার সুযোগ থাকছে। ওই কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে কম মূল্যে পণ্য সংগ্রহ ও বিপণনের জন্য ভারত আদর্শ আমদানি উৎসে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত থেকে প্রতিযোগিতা সক্ষম মূল্যে পণ্য পাওয়া গেলে তাকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে বাজার বৈচিত্র্যকরণের গুরুত্ব রয়েছে। একক দেশের ওপর নির্ভরতার কিছু বিপদও রয়েছে। গম বা তুলার মতো অপরিহার্য পণ্য রফতানি আকস্মিক বন্ধ হয়ে গেলে তা নতুন সংকটের জন্ম দেবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য বাড়াতে হবে। কারণ সারা বিশ্বেই এখন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোয় মন্দা দেখা দিয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। এমন অবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কারে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ জানান, ভারত সম্প্রতি গম রফতানি বন্ধ করেছে। তারপর চিনিও বন্ধ করেছে। আবার তুলার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতে পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে যে কোনো পণ্য আমদানির জন্য ভারত সবচেয়ে ভালো বিকল্প দেশ। কারণ প্রচলিত উৎসগুলো থেকে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ভারত সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে গেলে ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ফলে অন্যান্য উৎস থেকে আমদানির পরিকল্পনাও রাখতে হবে। ভারতের বিকল্প অবশ্যই রাখতে হবে। যদিও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের স্থল-নৌ-রেল অনেকগুলো মাধ্যম আছে। আর বর্তমান বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্কটে দুই দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। তবে আগের খারাপ অভিজ্ঞতাও মনে রাখতে হবে।