October 6, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, February 3rd, 2023, 3:25 pm

পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটে মাটির পণ্য

সিলেট অফিস :

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের কুমারপাড়া (ঢুপি) গ্রামে আগে শতাধিক পরিবার মাটির তৈরি জিনিস বিক্রি করে সংসার চালাত। তবে এখন হাতে গোনা ১৮–২০টি পরিবার এ পেশায় যুক্ত আছে। মৃৎশিল্পীরা বলছেন, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির পণ্য।

সম্প্রতি গ্রামটিতে ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে ২০ ঘরের শিল্পীরা মিলে একটি চুলা তৈরি করেছেন। সে চুলায় মাটির তৈরি জিনিস পুড়িয়ে পোক্ত করা হয়। এরপরই সেগুলো পাইকারদের কাছে সরবরাহ করা হয়। গ্রামের পাশের পতিত জমি থেকে গর্ত করে এঁটেল মাটি সংগ্রহ করতে দেখা গেছে গ্রামের কয়েকজনকে। তাঁরা বলেন, শীতের সময়ে ওই জমি থেকে গর্ত হিসাবে টাকা দিয়ে মাটি কিনতে হয়। তবে মাটিগুলোর ওপরের অংশ থেকে তিন–চার ফুট নিচে খোঁড়ার পর এঁটেল মাটি সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে চলে মৃৎশিল্পের কাজ।
শুধু জৈন্তাপুর নয় সিলেট জেলার ওসমানী নগর, দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিশ্বনাথসহ সবকটি উপজেলায় ও মাটির পন্য বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এর সাথে জড়িতরা বিকল্প পেশায় ঝুকে পড়ছে।
জেলার মৃৎশিল্পীরা বলছেন, মাটি থেকে শুরু করে পোড়ানোর জন্য কাঠ সবকিছু কিনতে হয়। এর মধ্যে কাঠের মিলগুলো থেকে গুঁড়া বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণে খরচের সঙ্গে আয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই। আগে বছরের ছয় মাস গ্রামের প্রতিটি ঘরে মাটির জিনিস তৈরির উৎসব লেগে থাকত। কার্তিক থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় মেলা কেন্দ্র করে মাটির তৈরি জিনিসের চাহিদা থাকলেও বছরের বেশির ভাগ সময় কাজ থাকে না তাঁদের।

কবিন্দ্র রুদ্রপাল (৬০) নিজ বাড়ির উঠানে মাটির দলা থেকে চরকি ঘুরিয়ে ব্যাংক ও ফুলের টব তৈরি করছিলেন। তাঁর পাশে এঁটেল মাটির ঢিবি থেকে মাটি নিয়ে একের পর এক ফুলের টব ও ব্যাংক বানিয়ে রোদে শুকানোর জন্য সারবদ্ধভাবে রাখছিলেন। তিনি বলেন, গ্রামে যাঁরা মাটির জিনিস তৈরি করেন, তাঁদের অধিকাংশই এখন নারী। পুরুষেরা কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকেছেন। এ ছাড়া অন্য এলাকায় মজুরির কাজের সন্ধানে বের হন অনেকে। এখন গ্রামের ১৮–২০টি পরিবার মৃৎশিল্পের কাজ করছে। কিন্তু এসব পরিবার বর্তমানে আগের তুলনায় কম মালামাল তৈরি করে।

ছেলেরা আর এ পেশায় আসবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁর বাবার হাত ধরেই তিনি মাটি দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করা শিখেছিলেন। এ কাজ করেই সংসার চালিয়েছেন। এখন আর এ কাজ করে সংসার চালানোর ক্ষমতা নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ এবং অবসর সময়ে মাটির জিনিস তৈরি করেন তিনি। চাহিদা এবং খরচ মিলিয়ে আয় হয় কম। অন্যদিকে প্লাস্টিক আর অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি জিনিসের দাম কম। ফলে ক্রেতারা সেগুলো কেনেন।

মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত মাটি দিয়ে জিনিস বানানোর কাজ চলে কার্তিক থেকে ফাগুন মাস পর্যন্ত। বছরে শীতের মৌসুমে গ্রামগঞ্জে মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। মাটির তৈরি খেলনার পাশাপাশি হাঁড়িপাতিলও সেখানে বিক্রি হয়। এ ছাড়া মাটির ব্যাংক, ফুলের টবের চাহিদা থাকে বছরজুড়ে। এর পাশাপাশি মাটির তৈরি জালের কাঠিও বানিয়ে থাকেন মৃৎশিল্পীরা। মাটি, কাঠ, গুঁড়াসহ সব মিলিয়ে ১০ হাজার টাকা খরচ করে মালামাল তৈরি করলে মাসে ১৫ হাজার টাকার মতো আয় হয়। তবে সেগুলো নির্ভর করে ফরমাশের ওপর। ফরমাশ বেশি হলে লাভের পরিমাণ কিছুটা বাড়ে।

রাখি রুদ্রপাল (৩০) নিজ ঘরের সামনে বসে মাটির থালা তৈরি করছিলেন। তিনি বলেন, বাজারে অন্য জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, শুধু মাটির তৈরি মালামালের দাম কমছে। কিন্তু শিল্পীদের খরচ ঠিকই বৃদ্ধি পেয়েছে। গৃহস্থালির কাজ এবং বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পের কাজের বাইরে তাঁরা তেমন কাজ জানেন না, এ জন্য পেশা বদল করা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর স্বামীর সঙ্গে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন। বিভিন্নজন এসে নাম-ঠিকানা নিয়ে যায়, কিন্তু কোনো সহায়তা কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা আসে না।

লাকি রুদ্রপাল (৪০) বলেন, সরকারি সহায়তা দূরের কথা, ঋণ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য বাধ্য হয়ে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অধিক সুদে ঋণ নিতে হয়। কুমারপাড়ার বাসিন্দাদের জন্য সহজ শর্তে ও বিনা শর্তে সরকারি ঋণের ব্যবস্থা করা হলে এ শিল্পের বিকাশ ঘটত। ঋণ পাওয়া গেলে পাইকারদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিতে হতো না। পাইকারেরা অগ্রিম টাকা দিলে মালামালের দাম কম নির্ধারণ করেন। এতে শিল্পীদের পারিশ্রমিক থাকে না।

জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল-বাশিরুল ইসলাম বলেন, ‘মৃৎশিল্পের বিকাশে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ, ঋণ কিংবা সহযোগিতা দেওয়া যায় কি না, খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’