October 8, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, October 11th, 2021, 8:52 pm

পোশাক শিল্পে এ কীসের অশনি সংকেত

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছিল ভিয়েতনাম। গত দু-তিন বছরে ব্যবধানটি পিঠাপিঠি নিয়ে এসেছিল দেশটি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে টপকে একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে চলে গেছে ভিয়েতনাম। আর বাংলাদেশ নেমে গেছে তৃতীয় স্থানে। বরাবরের মতো চীন সবার ওপরেই আছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০২১ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ডব্লিউটিও। এতে দেখা যায়, ২০২০ সালে ভিয়েতনাম ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। আর বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। অথচ তার আগের বছর বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। তখন ভিয়েতনামের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার।
রপ্তানির পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে রপ্তানির হিস্যাও কমেছে বাংলাদেশের। ২০১৯ সালে বিশ্বে যত পোশাক রপ্তানি হয়, তার মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল বাংলাদেশি। গত বছর সেটি কমে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে ভিয়েতনামের বাজার হিস্যা গত বছর ৬ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য ২০১০ সালে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। তখন ভিয়েতনামের ছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ। ১০ বছরের ব্যবধানে সেই ভিয়েতনামই টপকে গেল বাংলাদেশকে।
অবশ্য বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকেরা বলছেন, করোনার কারণে গত বছর প্রায় এক মাস পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। সে সময় পণ্য রপ্তানি হয়নি। অনেক ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। ফলে বন্ধের পর কারখানা খুললেও ক্রয়াদেশ কম ছিল। সে কারণে সহজেই ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে পেছনে ফেলতে পারে। তবে চলতি বছর চিত্র আবার পাল্টে যাবে। কারণ, বর্তমানে প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে।
গাজীপুরে দুটি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে শ্রমিকেরা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা সোয়া ১টা পর্যন্ত তাঁরা গাজীপুরে সিটি করপোরেশনের বাসন সড়ক ও ভোগড়া এলাকার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন।
পোশাক খাতের তীব্র প্রতিযোগিতার বিশ্বে বাংলাদেশকে যখন লড়তে হচ্ছে চরমভাবে তখন গাজীপুরে দুটি পোশাক কারখানার বন্ধের ঘোষণা শোনা গেল।
শ্রমিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বাসন এলাকায় ইন্টারলিং অ্যাপারেলস কারখানার শ্রমিকেরা শনিবার রাত পর্যন্ত কাজ করে বাসায় ফেরেন। রোববার সকালে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করার কথা। কিন্তু তাঁরা কারখানায় কাজে এসে দেখেন ফটকে তালা ঝুলছে। ফটকের সামনে কারখানা বন্ধের নোটিশ দেখতে পেয়ে সহ¯্রাধিক শ্রমিক বিক্ষুব্ধ হন। সকাল ৮টায় তাঁরা কারখানার ফটকের সামনে বিক্ষোভ-মিছিল করেন। পরে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের বাসন সড়ক এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
এদিকে ভোগড়া এলাকায় একই মালিকের অধীন অপর একটি কারখানার শ্রমিকেরা রোববার সকাল ৮টায় প্রধান ফটকের সামনে কারখানা বন্ধের নোটিশ দেখতে পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে মহাসড়কটির উভয় দিকে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। যাত্রীরা গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে ছুটতে থাকেন।
পোশাকশ্রমিকদের ভাষ্য, প্রতি মাসে বেতন পরিশোধ করার সময় এলেই কর্তৃপক্ষ নানা বাহানা শুরু করে। এ মাসেও একই রকম ঝামেলার সৃষ্টি করছে। তারা শ্রমিকদের অকারণেই ছাঁটাই করছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কাজ করছে বলে জানা যায়। পুলিশ জানায়, কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
পোশাক কারখানা অকস্মাৎ বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে কারখানা কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষ নোটিশে উল্লেখ করে, করোনা মহামারির কারণে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পরের বছর মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। তার মধ্যে ৯০ শতাংশ বা ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পণ্যই ছিল পাট ও পাটজাত। পাটের পর প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল চা ও হিমায়িত খাদ্য। যদিও মোট রপ্তানিতে এ পণ্য দুটির অবদান ছিল সোয়া শতাংশের কাছাকাছি।
৫০ বছর আগের পণ্য রপ্তানিচিত্রের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চেহারার খোলনলচে বদলে দিয়েছে তৈরি পোশাক খাত। পাটকে হটিয়ে পণ্য রপ্তানির শীর্ষস্থান দখল করেছে পণ্যটি। পাঁচ দশকের ব্যবধানে রপ্তানি আয় ৯৬ গুণ বৃদ্ধি, প্রায় ৪০ লাখ গ্রামীণ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, সহযোগী শিল্পের বিকাশসহ অনেক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে পোশাকশিল্প। চীনের পর একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ ছিল বাংলাদেশ, যদিও সম্প্রতি সে জায়গা দখল করেছে ভিয়েতনাম। পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যার দিক থেকেও বিশ্বে সবার ওপরে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে তৈরি পোশাক খাত বড় বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শক্ত ভীত গড়েছে বিশ্ববাজারে। অথচ স্বাধীনতার পর পণ্য রপ্তানির তালিকায় তৈরি পোশাকের কোনো নাম-নিশানা ছিল না।
বেসরকারি খাতে ১৯৭৮ সালে রিয়াজ গার্মেন্টসের মাধ্যমে পোশাক রপ্তানির যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠানটি ১০ হাজার পিস শার্ট রপ্তানি করেছিল ফ্রান্সে। সেই চালানে ১ লাখ ৩০ হাজার ফ্রাঁ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে রিয়াজ উদ্দিনের হাতে গড়া রিয়াজ গার্মেন্টস। সেই থেকে শুরু। তারপর আসে দেশ গার্মেন্টস। সরকারি চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে নুরুল কাদের খান প্রতিষ্ঠা করেন দেশ গার্মেন্টস। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৯ সালে পোশাক রপ্তানি শুরু করে। কাজ শেখানোর জন্য দেশ গার্মেন্টসের ১৩০ জনকে সে সময় কোরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন নুরুল কাদের। তাঁদের অনেকেই পরে পোশাক কারখানার মালিক হন।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওপেক্স নামে পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন আনিসুর রহমান সিনহা। দ্রুতই প্রতিষ্ঠানটির কলেবর বাড়তে থাকে। বছর দশকের মধ্যেই ৪৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান করতে সক্ষম হয়। ওপেক্সের কাছাকাছি সময়ে আনিসুল হক, এ কে আজাদ, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, কুতুবউদ্দিন আহমেদসহ আরও অনেকে পোশাকের ব্যবসায় আসেন। সে সময়কার অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন পোশাক খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি দেশে অন্যান্য খাতেও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান।
সস্তা শ্রম, সরকারের নীতিসহায়তা আর উদ্যোক্তাদের নিরলস পরিশ্রমের কারণে পোশাকশিল্পের কলেবর দ্রুতই বাড়ে। ফলে ২০০৫ সালে কোটাব্যবস্থা উঠে গেলেও থেমে থাকেনি বাংলাদেশ। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপি কাজে লাগিয়ে এগোতে থাকে খাতটি। কানাডাসহ কয়েকটি দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে ভালো সহায়তা করে।
কোটাব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর পোশাকের খাতে বড় ধাক্কাটি আসে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। সেদিন তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকা-ে শতাধিক শ্রমিক মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। সেটি সামলে ওঠার আগেই মালিকদের অবহেলায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে, যা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা। রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক মারা যান।
পাঁচ মাসের ব্যবধানে বড় দুটি ঘটনায় অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জে পড়ে তৈরি পোশাক খাত। দেশে দেশে বাংলাদেশি পোশাক বর্জনের ডাক দেয় শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। তীব্র সমালোচনার মুখে বিদেশি ক্রেতা ও শ্রম সংস্থার উদ্যোগে কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের উদ্যোক্তারা। বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে কারখানার কাঠামোগত, বৈদ্যুতিক ও অগ্নিসংক্রান্ত ত্রুটি সংস্কার করে বিশ্বে ইতিবাচক বার্তা দিতে সক্ষম হন তাঁরা।
তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকা- ও রানা প্লাজা ধসের পর ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়ায় পোশাক খাত। বিষয়টি বোঝার জন্য একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। ২০১০-১১ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ছিল ১ হাজার ৭৯১ কোটি ডলারের। তারপর ৯ বছরের ব্যবধানে সেই রপ্তানি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। তবে করোনাকালে নতুন করে সংকটে পড়েছে খাতটি। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে, খাতটির উদ্যোক্তারাই তা বলছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো সারা বছর যে পরিমাণ টি-শার্ট বা গেঞ্জি কেনে, তার প্রায় ৪০ শতাংশই বাংলাদেশি পোশাক কারখানা সরবরাহ করে। কেবল টি-শার্ট নয়, ট্রাউজার, শর্টস প্যান্ট ও পুরুষ বা বাচ্চাদের শার্ট রপ্তানিতে ইইউতে সবার ওপরে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ডেনিম রপ্তানিতে ইইউর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও শীর্ষস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।
পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র খাত। সেই সাফল্যে যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন পালক। গত অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, পরিবেশবান্ধব শীর্ষ দশে স্থান করে নেওয়া ২৭টি শিল্প স্থাপনার মধ্যে ১৪টিই বাংলাদেশের কারখানা। এ ছাড়া ভারতের তিনটি ও তাইওয়ানের দুটি কারখানা রয়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, পোল্যান্ড, মেক্সিকো, ইউএই, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া ও আয়ারল্যান্ডের একটি করে কারখানা আছে শীর্ষ দশে। তৈরি পোশাক খাতে এত অর্জনের ভিড়ে শ্রম অধিকার ইস্যুতে মাঝেমধ্যেই সমালোচনার তির বিদ্ধ হচ্ছে। সংগঠন করতে গেলেই শ্রমিকদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ করেন শ্রমিকনেতারা।
এ বিষয়ে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হকের ভাষ্য, ‘অবশ্যই স্বাধীনতার ৫০ বছরে তৈরি পোশাক খাত বড় বিস্ময়। যদিও সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগাতে পারলে তৈরি পোশাকশিল্পের অবস্থান আরও ভালো জায়গায় থাকত। আগামী ১৫-২০ বছর অনায়াসে এ খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নেতৃত্ব দেবে। যদিও ভবিষ্যতে নির্ভরশীলতা বর্তমানের মতো থাকবে না। বেশি দাম ও উচ্চপ্রযুক্তির পোশাকসহ অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কাজ করা বাকি রয়েছে। সব মিলিয়ে তৈরি পোশাক খাত নিয়ে আরও অনেক পথ অতিক্রম করা বাকি রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এমতাবস্থায় গাজীপুরে পোশাক কারখানার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা একটি বড় ধাক্কা। কারখানার শ্রমিকদের যথাযথ বেতন না পাওয়ার ব্যাপারটিও হতাশার। এটি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।