নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীদের কর ফাঁকি বন্ধ করা যাচ্ছে না। বরং বিদেশীরা প্রকৃত বেতনভাতা গোপন করে ওয়ার্ক পারমিট নেয়ায় আয়কর হারাচ্ছে সরকার। আর বাকি টাকা হুন্ডিতে পরিশোধ করায় দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে অর্থ। এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) বিদেশী কর্মীদের কাছ থেকে কর আদায়ে সব উদ্যোগই ব্যর্থ। খাতাকলমে বন্দি রয়েছে বিমানবন্দরে আয়কর বুথ স্থাপন, বিদেশী নাগরিক কাজ করে তেমন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে টাস্কফোর্স গঠন এবং তথ্যভান্ডারের পরিকল্পনা। বিদেশীদের এদেশে বৈধভাবে কাজ করতে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অনুমতি নিতে হয়। তাছাড়াও এনজিও ব্যুরো ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষও (বেপজা) বিদেশিদের কাজের অনুমতি দিয়ে থাকে। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বিদেশিদের হয়ে অনুমতি নিয়ে থাকে। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে এদেশে বিদেশি করদাতা হিসাবে নিবন্ধিত আছে ১ লাখ ৪ হাজার ৫৬৫ জন। ওসব বিদেশী করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৩৭ হাজার ৬৭৭ জন কর অঞ্চল-১১তে নিবন্ধিত আছে। তার পরের অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-২। সব বিদেশীর কর অঞ্চল-১১তে নিবন্ধন নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের অধিক্ষেত্র অনুযায়ী নিবন্ধিত হওয়ায় ঠিক কত বিদেশি করদাতা নিয়মিত রিটার্ন জমা দেয় এনবিআরের প্রতিবেদনে ওই তথ্য উল্লেখ নেই। তাছাড়াও এনবিআরের আওতায় নিবন্ধিত আছে বাংলাদেশে ৭৯২টি বিদেশী কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিস এবং ৩৬৫টি ব্রাঞ্চ অফিস।
সূত্র জানায়, দেশে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশি অবস্থান করছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৬৭ জন। তার মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬৮৯ জনের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে। ভারতের নাগরিকরা টুরিস্ট ক্যাটাগরিতে এদেশে বেশি এসেছে আর বিজনেস ক্যাটাগরিতে এসেছে চীনের নাগরিকরা। বর্তমানে ৬৮ হাজার ৩০৫ জন ভারতীয় নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তারা এদেশে অবস্থান করছেন। তার পরের অবস্থানেই রয়েছে চীনের নাগরিকরা। অন অ্যারাইভাল ভিসাতেই বাংলাদেশে বেশি বিদেশী নাগরিক প্রবেশ করেছে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশীদের কর নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করতে হয় বলে প্রকৃত বেতন আড়াল করে এক-তৃতীয়াংশ কম বেতন প্রদর্শন করে বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট নেয়া হয়। আফ্রিকানরা খেলোয়াড় কোটায় এসে পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে গার্মেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া সরকারি প্রকল্পে তিন শ্রেণির ভিসা নিয়ে এসে অনেকেই বেসরকারি কাজও করছে। তাতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
সূত্র আরো জানায়, ইতঃপূর্বে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিদেশিদের কাছ থেকে কর আদায়ে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আর ওই টাস্কফোর্সে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), পুলিশের বিশেষ ব্রাঞ্চ (এসবি), ডিজিএফআই, এনএসআই, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেপজা, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, এনজিও ব্যুরো ও এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে কাজের সুবিধার্থে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলভিত্তিক টাস্কফোর্সকে ভাগ করা হয়। ওই টাস্কফোর্সের কাজ ছিল প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে কর ফাঁকিবাজ বিদেশীদের চিহ্নিত এবং কর্মরত বিদেশিদের ডেটাবেজ তৈরি করা। শুরুর দিকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান হলেও পরে তা ঝিমিয়ে পড়ে এবং এখন বন্ধ রয়েছে কার্যক্রম। ওই টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও একটি স্থলবন্দরে আয়কর বুথ চালু করা হয়। ঢাকার হযরত শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত, সিলেটের এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরে আয়কর বুথে সহকারী কর কমিশনার পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওসব বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগের আগে বিদেশিদের আয়কর প্রত্যয়নপত্র দেখানোর নিয়ম চালু করা হলেও এখন ওই বুথগুলোও বন্ধ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিদেশি কর্মীদের নিয়ে বাংলাদেশে অনেকগুলো সংস্থা কাজ করে। কোনো সংস্থা কাজের অনুমতি দেয়, আবার কোনো সংস্থা কর্মীদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। সব সংস্থার সমন্বয়ে ডেটাবেজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ডেটাবেজ তৈরির কাজ এগোয়নি। তিনি আরও বলেন, বিমানবন্দরে আয়কর বুথ থাকার কথা। সেগুলো কী অবস্থায় আছে, তা জেনে জানাতে হবে। আর টাস্কফোর্সের কার্যক্রম বন্ধ আছে।
এদিকে এনবিআর সংশ্লিষ্টদের মতে, অধিকাংশ বিদেশি কর্মী বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে টুরিস্ট ভিসা ব্যবহার করে। তারপর তারা বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। এনজিও, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রকৌশল, চিকিৎসা, গার্মেন্ট, মার্চেন্ডাইজিং, পরামর্শকসহ নানা পেশায় বিদেশীরা কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশিদের বেতনভাতা গোপন রাখা হচ্ছে। কারণ বিদেশিদের আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ আয়কর ধার্য আছে। দেশীয় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ মূলত কর ফাঁকি দিতেই ওই কৌশল অবলম্বন করছে। পাশাপাশি গোপন চুক্তি অনুযায়ী বেতনভাতা পরিশোধ করতে মানি লন্ডারিংয়ের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। তাতে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা পাচার হচ্ছে।
অন্যদিকে বিডার ৩৩৭তম আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিদেশী কর্মীদের বেতনভাতা কম দেখানোর মাধ্যমে কর ফাঁকি দেয়া নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় যেসব প্রতিষ্ঠানে বিদেশি কর্মী কর্মরত আছে ওসব প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্টে ওয়ার্ক পারমিট অনুসারে বিদেশিদের বেতনভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে কিনা তা অডিট রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট তৈরিতে হিসাববিদদের সংগঠন দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশকে (আইসিএবি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী অবৈধভাবে বিদেশীদের নিয়োগ দিলে জেল-জরিমানার বিধান আছে। কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিদেশিদের নিয়োগ দিলে নিয়োগদাতা হিসাবে ওই ব্যক্তিকে সর্বনি¤œ তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদ- অথবা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক দ- বা উভয় দ-ে দ-িত করার বিধান আছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি