নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মূল্যস্ফীতির মোকাবিলায় বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো কৃচ্ছ সাধনের পথে হাঁটছে। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে ওই প্রভাব পড়েছে। তার জের ধরে বিদেশী ক্রেতারা একদিকে যেমন অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে আগের দেয়া অর্ডারও নিচ্ছে না। বরং পোশাকের দাম কমাতে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধিতে শিল্প মালিকরা বিপাকে। আর ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে গড়িমসি করছে। সব মিলিয়ে দেশের পোশাক শিল্প চতুর্মুখী সংকটে পড়েছে। আর সামনের দিনগুলোতে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল দিয়েও বাড়ানো যাচ্ছে না পোশাক বিক্রি। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে চাচ্ছে না। এমনকি পুরোনো যেসব অর্ডার উৎপাদন শেষে শিপমেন্টের অপেক্ষায় আছে সেগুলোও নিতে চাচ্ছে না। ওসব পণ্য ওয়্যারহাউজে পড়ে আছে। ডেফার্ড পেমেন্টে ওসব পণ্য নেয়ার অনুরোধ জানালেও তাতে সাড়া দিচ্ছে না। পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটেও তৈরি পোশাকের অর্ডার কমছে। বর্তমানে দিনের বেশির ভাগ সময় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের চাপ থাকছে না। লোডশেডিংয়ের শিডিউলেও উৎপাদনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। কারণ কখন, কতক্ষণ লোডশেডিং হবে তা কেউ বলতে পারছে না। সব মিলিয়ে জ্বালানি পরিস্থিতি ক্রেতাদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিদেশি ক্রেতারাও জ্বালানি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ জ্বালানি সংকটের কারণে সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দিতে পারবো কিনা তা নিয়ে ক্রেতাদের মাঝে সংশয় রয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকার কারখানাগুলোতে দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। অনেকে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু বড় কারখানাগুলোয় দৈনিক গড়ে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার ডিজেল লাগছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। পাশাপাশি টেক্সটাইল মিলগুলোতে অনেক আগে থেকেই গ্যাস সংকট রয়েছে। দিনের বেশিরভাগ সময় চাপ থাকছে না। ঘন ঘন লোডশেডিং ও গ্যাসের চাপ ওঠানামার কারণে কারখানার যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক শিল্প মালিকই বাধ্য হয়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কথা ভাবছে। আগে যেখানে এক কেজি সুতা উৎপাদনে এক ডলার ২৫ সেন্ট খরচ হতো, এখন সেখানে ২ ডলারের বেশি খরচ হচ্ছে। গ্যাস সংকটে ৬০ ভাগ টেক্সটাইল মিল বন্ধের ঝুঁকিতে পড়েছে। কোথাও কোথাও দিনে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না। আবার গ্যাস থাকলেও চাপ থাকে না। এতে সুতা উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে পড়ছে বিধায় প্রতিযোগী সক্ষমতায় টিকে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে না পারলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
সূত্র আরো জানায়, দেশের টেক্সটাইল শিল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ এখন জ্বালানি সংকট। দেশে গ্যাসই একমাত্র শিল্পের কাঁচামাল। বাকি সবকিছুই আমদানি করতে হয়। জ্বালানি সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হলে পুরো বস্ত্রখাতে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। করোনাকালীন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করায় শিল্প ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছিল। ওই প্যাকেজের ৮০ ভাগ টাকাই পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও করোনাকালীন সময়ের মতো ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট প্রয়োজন। কারণ ডলার সংকট মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে বস্ত্র খাত। ওই খাতে এক মিলিয়ন ডলারের গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে ২০ মিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, পোশাক শিল্প আন্তর্জাতিক ও দেশিয় চতুর্মুখী চাপে পড়েছে। বিশ্বমন্দার কারণে অর্ডার কমে গেছে। বিদেশিদের কাছ থেকে অর্ডার আনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে অর্ডার নেয়া যাচ্ছে না। ওই কারণে বিদেশি ক্রেতারাও অর্ডার দিতে সংকোচবোধ করছে। তার ওপর বন্ড-কাস্টমসের ঝামেলা তো আছেই। সরকার এই শিল্পকে পলিসি সহায়তা দেয়ায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ সাপোর্ট না দিলে শিল্পের ভবিষ্যৎ শঙ্কায় রয়েছে।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম জানান, বৈশ্বিক মন্দার মতো আন্তর্জাতিক সংকট সমাধানে চাইলেও কিছু করার নেই। তবে দেশের সংকটগুলো যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি এবং ব্যবসা সহজীকরণের মতো পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে। স্থানীয় সংকটগুলো মোকাবেলা করা গেলেও শিল্পের সক্ষমতা বাড়বে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি