নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের বিপুলসংখ্যক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই রিটার্নের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনেদেরন ব্যাপক অমিল পাওয়া গেছে। বছরে ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি লেনদেন হয়েছে এমন এক হাজার ৭০০টি প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের আয়-ব্যয়, আমদানি-রপ্তানি, স্থানীয় বাজারে বিক্রির এবং ভ্যাট পরিশোধের তথ্য খতিয়ে দেখে ৫০৭টি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ৪ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের খোঁজ মিলেছে। তার মধ্যে বেচাকেনায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে এক হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ২৩৩টি প্রতিষ্ঠান। আর বাকি ২৭৪টি প্রতিষ্ঠান বেশি পরিমাণ আমদানির কথা বলে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে দুই হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা পাচার করেছে। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং বন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তারা আলাদাভাবে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তদন্ত শেষে ভ্যাট ফাঁকি ও অর্থপাচারের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। তার মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান পাওনা ভ্যাট পরিশোধ করেছে বা তা অচিরেই পরিশোধে অঙ্গীকার করেছে তাদের সুযোগ দেয়া হবে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান এক টাকাও ভ্যাট পরিশোধ করেনি তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে মামলা করা হয়েছে। বœ তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুসারে গত জুলাই থেকে পর্যায়ক্রমে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ কাঁচামাল কিনে কতটা উৎপাদন করে কী দামে কিভাবে বিক্রি করেছে ভ্যাট রিটার্নে ২৩৩টি প্রতিষ্ঠান তার তথ্য সঠিকভাবে উল্লেখ করেনি। বরং প্রতিটি হিসাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারের পাওনা ভ্যাটের চেয়ে অনেক কম পরিশোধ করা হয়েছে। বড় মাপের ২৩৩টি প্রতিষ্ঠান প্রকৃতপক্ষে যে কাঁচামাল কিনেছে তার দাম ব্যাংকিং লেনদেনের মাধ্যমে পরিশোধ করেছে আর উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে যে টাকা পেয়েছে তাও ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রহণ করেছে। সেজন্যই ভ্যাট রিটার্নে দেয়া মিথ্যা হিসাবের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্যের মিল পাওয়া যায়নি। ভ্যাট রিটার্নে যে হিসাব দেখিয়েছে ব্যাংকিং লেনদেন হয়েছে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ২৩৩টি প্রতিষ্ঠান প্রকৃতপক্ষে বেশি পরিমাণের পণ্য উৎপাদন করে উচ্চদরে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করে লাভ করেছে। যা ব্যাংকিং লেনদেনের সঙ্গে মিল রয়েছে।
সূত্র জানায়, ভবিষ্যতে কেনাবেচা ও ভ্যাট পরিশোধের তথ্যে স্বচ্ছতা আনতে ২৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে বিজনেস ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার (বিআই) নামে নতুন সফটওয়্যারের সাহায্যে ভ্যাট গোয়েন্দারা সংযুক্ত করে দিয়েছে। তাতে ভ্যাটের টাকা পরিশোধের জন্য ব্যাংকে অনুরোধ বার্তা পাঠানোর পর সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তা জমা (ট্রেজারি ডিপোজিট) হবে। তারপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা এনবিআরে রক্ষিত সমন্বিত ভ্যাট প্রশাসন পদ্ধতির (আইভিএএস) তথ্য ভা-ারে আসবে।
সূত্র আরো জানায়, দেশের ২৭৪টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। কিন্তু ওসব প্রতিষ্ঠান ভুয়া ও জাল কাগজপত্র দিয়ে বেশি পরিমাণ ও বাড়তি দামে কাঁচামাল আমদানি করার কথা বলে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে বিদেশে নির্দিষ্ট কিছু বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে টাকা পাঠিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানগুলো কম দামের অল্প পরিমাণ কাঁচামাল এনেছে। ২৭৪টি প্রতিষ্ঠানই বিদেশে নিজের পছন্দমতো বিভিন্ন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগেই সমঝোতা করে কম পরিমাণ কম দামের কাঁচামাল কিনলেও দর হিসেবে প্রকৃত দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পাঠিয়ে তা বিদেশেই নিয়ে নেয়। এভাবেই ওই প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অর্থপাচার করে। ব্যাংকের এলসির তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে বন্দর থেকে ২৭৪টি প্রতিষ্ঠান কী পরিমাণের কোন কাঁচামাল কোন দেশের কোন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে এনেছে তার তথ্য সংগ্রহ করে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। আমদানি করা কাঁচামালের কতটা কারখানায় আনা হয়েছে, তার কতটা ব্যবহার করে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করেছে, উৎপাদিত পণ্যের কতটা রপ্তানি করে বিক্রি দর হিসেবে ব্যাংকে কী পরিমাণ টাকা এসেছে ওই তথ্যও খতিয়ে দেখা হয়েছে। তদন্তে দেখা যায়, অল্প পরিমাণ কাঁচামাল এনে ওসব প্রতিষ্ঠান নামমাত্র পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। কিন্তু কাঁচামালের দাম হিসেবে অনেক বেশি টাকা পাঠিয়ে বছরের পর বছর অর্থপাচার করা হয়েছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আব্দুর রউফ জানান, আমদানি-রপ্তানিতে অনেকেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে অর্থপাচারের মতো জঘন্য কাজ করছে। এনবিআর এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করছে।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানান, লাভজনক ব্যবসা করেও অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কম ভ্যাট পরিশোধ করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। তদন্ত করে ওসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হিসাবমতো রাজস্ব আদায়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এনবিআর।
আরও পড়ুন
নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে গিয়ে গুরুতর আহতদের খোঁজখবর নিলেন প্রধান উপদেষ্টা
যমুনা সেতুতে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-ছেলেসহ নিহত ৩
খুলনায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাঁচাবাজার, নেই মনিটরিং