July 27, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, January 7th, 2022, 9:57 pm

বিপুল অর্থ বিনিয়োগ সত্ত্বেও যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে পিছিয়ে পড়ছে রেল

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক :

বিপুল অর্থ বিনিয়োগ সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে পিছিয়ে পড়ছে রেল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে বর্তমানে রেলে যাত্রী পরিবহনের অবদান কমে গেছে। একই সঙ্গে মোট পণ্য পরিবহনেও কমেছে রেলের অবদান। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ভুল নীতি ও উন্নয়ন সহযোগীদের কৌশলী ভূমিকা দেশের রেলওয়ে খাতকে ক্রমেই খাদের কিনারে ঠেলে নিয়ে গেছে। ফলে বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলের হারানো গৌরব ফেরানো যাচ্ছে না। যদিও রেলের সংশ্লিষ্টদের দাবি, রেলের উন্নয়নে নেয়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বিদ্যমান চিত্র বদলে যাবে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রেল খাত বিগত এক দশক ধরেই জাতীয় বাজেটে পরিবহন খাতে বরাদ্দের ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ পেয়েছে। বিশেষ করে ২০১১ সালে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের পর রেল খাতে বরাদ্দ বাড়তে শুরু করে। চলতি অর্থবছর রেলে বরাদ্দের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। ৫ বছর ধরে প্রায় এ হারেই রেল খাত বরাদ্দ পেয়ে আসছে। ওসব টাকায় নতুন ইঞ্জিন-কোচ কেনা হয়েছে। বসানো হয়েছে নতুন লাইন। আধুনিকায়ন হয়েছে স্টেশন ও সিগন্যালিং ব্যবস্থার। কিন্তু যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ওসব উন্নয়ন খুব একটা লাগেনি।
সূত্র জানায়, দেশে সারা বছরের মোট যাত্রী চলাচল হিসাব করতে ব্যবহার হয় প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার (পিকেএম) একক। সেক্ষেত্রে দূরত্বের পরিমাণ যা-ই হোক, একজন যাত্রী যে কোনো মাধ্যমে একবারে এক কিলোমিটারের বেশি পাড়ি দিলেই তা এক পিকেএম হিসেবে হিসাব করা হবে। জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (ইএসসিএপি) তথ্যানুযায়ী স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে তেমন যাত্রার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭০০ কোটি। আর তার ৩০ শতাংশ বা প্রায় ৫১০ কোটি পিকেএম রেলপথে ছিল। ২০১৯ সালে দেশে প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার যাত্রীর সংখ্যা ছিল সাড়ে ১৯ হাজার কোটি। তার মধ্যে রেলওয়ে পরিবহন করেছে প্রায় দেড় হাজার পিকেএম, যা যাত্রার মাত্র ৮ শতাংশ। যাত্রীর মতোই রেলওয়েতে কমেছে পণ্য পরিবহন। ১৯৭৫ সালে যেখানে দেশের মোট পরিবাহিত পণ্যের ২৮ শতাংশই রেলপথেপরিবহন হয়েছিল। ২০১৯ সালে তা ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
সূত্র আরো জানায়, গত এক দশকে রেলে মোটা অংকের বিনিয়োগ হলেও তা বিচ্ছিন্নভাবে ও প্রকল্পকেন্দ্রিক হয়েছে। ফলে ওসব বিনিয়োগ যাত্রী ও পরিবহনে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারেনি। বরং অনেক সময়ই তা মন্দ বিনিয়োগে রূপ নিয়েছে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রামের একটি বড় অংশ ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ডাবল লাইনে রূপান্তর করা হয়েছিল। যদিও লাইন আগের মতোই মিটার গেজ থেকে যায়। ওই প্রকল্পের দুই অংশের বাস্তবায়ন ২০১৫ ও ২০১৮ সালে শেষ হয়। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই এখন রেলপথটি আবার ডুয়াল গেজ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তাছাড়া কোটি কোটি টাকা খরচ করে রেলের ইঞ্জিন কেনা হলেও অনেকগুলোরই মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বছরের পর বছর ব্যবহার না করেই এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সরঞ্জাম নষ্ট করা হয়েছে। সরকার যেখানে পর্যায়ক্রমে দেশের মিটার গেজ রেলপথ তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে কেনা হচ্ছে সাড়ে ৪০০ মিটার গেজ ওয়াগন। রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কার, স্টেশন ভবন আধুনিকায়ন, রোলিং স্টক সংগ্রহসহ বেশির ভাগ প্রকল্পেই সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। বিগত এক দশকে রেলে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হলেও পুরনো ইঞ্জিন-কোচ, নড়বড়ে রেলপথ, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, লোকবল সংকট, যাত্রীসেবায় অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা এখনো রেলওয়েতে প্রকট।
এদিকে বিগত এক দশকে রেলওয়েতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকার ৩৬টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। ওসব টাকায় নতুন রেলপথ-সেতু নির্মাণ, পুরনো রেলপথ-সেতু সংস্কার, ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ ও পুনর্বাসন, সিগন্যাল ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে। তারপরও জীর্ণ অবস্থা থেকে বের হতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে।
অন্যদিকে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে দেশের রেল খাতে বড় বড় বিনিয়োগ হলেও পরিকল্পনার দুর্বলতা ও অদূরদর্শীভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করায় মানুষ সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে রেলওয়েতে বড় বড় বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের বড় ঘাটতি রয়েছে। কোন কাজটি আগে করতে হবে, কোনটি পরে হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে না। রেলের আজকের এ অবস্থার জন্য প্রধানত তিনটি বিষয় দায়ী। প্রথমত, প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেলের সক্ষমতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যময় যাতায়াতের জন্য সংস্থাটি এখনো উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, সরকারের ভুল নীতি। অতীতের সরকারগুলো রেলের উন্নয়নের বদলে সড়কপথে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। দীর্ঘদিন উন্নয়নবঞ্চিত থাকার একটা শূন্যতা রেল খাতে তৈরি হয়েছে, যা থেকে এখনো রেল বের হতে পারেনি। তৃতীয়ত, উন্নয়ন সহযোগীদের কৌশলগত ভূমিকাও রেলকে পিছিয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে তারা সড়কপথের উন্নয়নের জন্য সহায়তা করলেও বঞ্চিত হয়েছে রেল খাত। এমন অবস্থা থেকে রেলকে বের করে আনতে হলে যাত্রী পরিবহনের জন্য নগরকেন্দ্রিক রেল যোগাযোগ উন্নয়নে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। সেজন্য মেট্রোরেল, সাবওয়ে, লাইট রেলের মতো অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আর পণ্য পরিবহনের জন্য দেশের সামগ্রিক রেল নেটওয়ার্ক যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে দেশের সিংহভাগ পণ্য রেলপথে পরিবহন করা সম্ভব হয়।
এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানান, দীর্ঘদিন রেল খাত উন্নয়নবঞ্চিত ছিল। ২০০৯ সালের দিকে রেলের চেহারা ছিল বিবর্ণ। পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় ট্রেন, নড়বড়ে রেলপথ, ভাঙাচোরা স্টেশন- সবখানেই ছিল দীর্ঘদিনের অনুন্নয়নের ছাপ। এখন কিন্তু ওই চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। বর্তমানে সারা দেশের সব রেলপথকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যমুনা নদীতে আলাদা রেলসেতু তৈরি করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু ও ঢাকা-যশোর রেলপথসহ দেশের সব জেলায় রেল যোগাযোগ স্থাপনে কাজ করা হচ্ছে। আনুষঙ্গিক সব ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেই জোর দেয়া হচ্ছে। সেগুলোর পূর্ণ সুফল তখনই পাওয়া যাবে, যখন চলমান ও পরিকল্পনাধীন কাজগুলো বাস্তবায়ন হবে।