নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশে সড়ক অবকাঠামো খাতে সরকার বিপুল টাকা ব্যয় করলেও তা টেকসই হচ্ছে না। বিগত ১০ বছরে দেশের মহাসড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়নে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর চার লেনের রাস্তা তৈরি, সড়ক-সেতু প্রশস্তকরণ, পুনর্বাসন, সংস্কার আর রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ওই অর্থ খরচ করেছে। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ নকশা, নিম্নমানের নির্মাণকাজ আর নির্মাণ-পরবর্তী পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতায় দেশের সড়ক অবকাঠামো টেকসই হচ্ছে না। ফলে সড়ক খাতে বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও তা টেকসই হচ্ছে না। বর্তমানে দেশজুড়ে সওজ’র সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি সড়ক খারাপ অবস্থায় রয়েছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশজুড়ে সওজের নেটওয়ার্কে থাকা সড়কের পরিমাণ সাড়ে ২২ হাজার কিলোমিটার। তার মধ্যে চার লেনের সড়কের পরিমাণ ৫০০ কিলোমিটার। ৮ আর ৬ লেনের সড়ক মাত্র ৩৮ কিলোমিটার। বর্তমানে সওজ’র নেটওয়ার্কে থাকা ৩ হাজার ৬৪৭ কিলোমিটার সড়ক খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তার মধ্যে ৮৩৯ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। আর খারাপ অবস্থায় রয়েছে সাড়ে ৯০০ কিলোমিটার সড়ক। তাছাড়া বেশ দুর্বল অবস্থায় রয়েছে আরো প্রায় ১ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার সড়ক। ওসব সড়ক মেরামত করতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার চাহিদা রয়েছে। সওজ ২০ বছর টেকসই করে সড়ক নির্মাণ করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো এক-দেড় বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। কখনো কখনো নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ওসব সড়ক অবকাঠামো সংস্কারেও সওজকে প্রতি বছর মোটা অংকের অর্থ খরচ করতে হয়।
সূত্র জানায়, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) কোন দেশের সড়ক কেমন তা সূচক আকারে নিয়মিত প্রকাশ করে। সড়কের প্রশস্ততা ও অবস্থা বিশ্লেষণ করে ডব্লিউইএফ তালিকাভুক্ত প্রতিটি দেশের সড়কের স্কোরিং করে। বিশ্বমানের সড়কের বৈশ্বিক তালিকায় তলানিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ সড়ক কেবল নেপালে আছে। বিগত ২০০৭ সালে ডব্লিউইএফের কোয়ালিটি অব রোডস সূচকে ভারত ছিল ৮২ নম্বরে। তার ঠিক পরে অর্থাৎ ৮৩ নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পরের এক দশকে ভালো মানের সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে ভারতের অবস্থান এখন ৫৫ নম্বরে। একই সময়ে বাংলাদেশ বিপুল বিনিয়োগ করলেও বিশ্বমানের সড়ক গড়ে ওঠেনি। বরং অবনমন হতে হতে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১০৭-এ।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সিংহভাগই সড়কনির্ভর। ফলে সড়ক খাতে দুর্বল অবকাঠামোর কারণে পণ্য ও মানুষের চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। যানজটে নাকাল হচ্ছে মানুষ। আর প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় দীর্ঘ হচ্ছে হতাহতের মিছিল। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনে লাগছে অতিরিক্ত সময়। তাতে বেড়ে যাচ্ছে পরিবহন ব্যয়। যার খেসারত দিচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
এদিকে দেশের দুর্বল সড়ক অবকাঠামো বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের উন্নয়নের লাইফলাইন হলো মহাসড়ক। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে হারে প্রবদ্ধি হচ্ছে, টেকসই মহাসড়ক গড়ে তুলতে পারলে প্রবদ্ধির হার আরো বেশি হতে পারতো। বাংলাদেশে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনের প্রায় পুরোটাই সড়কপথে হচ্ছে। কিন্তু দুর্বল সড়কের কারণে ওসব পণ্য বন্দর থেকে ভোক্তা পর্যায়ে কিংবা উৎপাদক থেকে বন্দরে পৌঁছাতে সময় বেশি লাগছে। ফলে তাতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি দুর্বল সড়ক অবকাঠামো এশিয়ান হাইওয়ে, সাসেক করিডরসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক করিডরে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অথচ আন্তর্জাতিক করিডরগুলোর মাধ্যমে চীন, ভারত, মিয়ানমার, ভুটান, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশে সড়কও নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো মানসম্পন্ন না হওয়ার কারণে যখন করিডরগুলো চালু হবে, তখন সেসব করিডরের ট্রাফিকের চাপ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো নিতে পারবে না। তবে এখনো বাংলাদেশের হাতে যথেষ্ট সময় রয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা ও সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে চাইলেই উন্নত মহাসড়ক গড়ে তোলা সম্ভব।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সড়কগুলোর খারাপ অবস্থায় চলে যাওয়ার পেছনে যানবাহনের ওভারলোডিংকে দায়ি করে সওজ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) মনির হোসেন পাঠান জানান, যতো ভালো মানেরই সড়ক বানানো হোক না কেন ওভারলোডিং হলে তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। এখানে এ ঘটনাই বেশি হচ্ছে। ওভারলোডিংয়ের কারণে রাটিংয়ের মতো সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সড়কে ওভারলোডিং নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশের মহাসড়কগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন শুরু করা হয়েছে। তাছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে সড়কের ঠিকাদাররা নিম্নমানের কাজ করে ফেলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা কাজ শেষ হওয়ার পর বোঝা যায়। তবে ঠিকাদাররা যেন নিম্নমানের কাজ করতে না পারে ওই লক্ষ্যে সওজ’র প্রকৌশলীরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। আর বর্তমানে বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম