নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্যে পরিণত হয়েছে মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য। বর্তমানে বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করা হচ্ছে। মোট রফতানি আয়ে মৎস্য খাতের অবদান ১ দশমিক ২৪ শতাংশ। আর মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০২০-২১ সালে দেশের মাছের মোট উৎপাদান দঁড়িয়েছে ৪৬ লাখ ২১ হাজার টন। আর সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৪ হাজার ৬৭ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে দেশের আয় হয়েছে ৫ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। যা গত বছরের চেয়ে ২৬ দশামিক ৯৬ শতাংশ বেশি। বিশ্বে ইলিশ আহরণে রোল মডেল বাংলাদেশ। ইলিশ আহরণকারী বিশ্বের ১১টি দেশের মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ। মূলত টেকসই উৎপাদন নীতির কারণেই মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। আর গত ১৬ বছরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ। মৎস্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে বিশ্বের ৫২টি দেশে বাংলাদেশ থেকে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করা হয়। মাছের পাশাপাশি অপ্রচলিত মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন এবং ওসব পণ্যের রফতানি উৎসাহিত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী কাঁকড়া, কুচিয়া ও সিউইডের চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রধানত গলদা, বাগদা, হরিণাসহ বিভিন্ন জাতের চিংড়ি; স্বাদুপানির মাছ রুই, কাতলা, মৃগেল, আইড়, টেংরা, বোয়াল, পাবদা, কৈ প্রভৃতি এবং সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ভেটকি, দাতিনা, রূপচাঁদা, কাটল ফিশ ইত্যাদি রফতানি হয়ে থাকে। তাছাড়াও শুঁটকি মাছ, মাছের আঁইশ এবং চিংড়ির খোলসও রফতানি করা হয়। বর্তমানে চাষের মাধ্যমে উৎপাদিত কাঁকড়াসহ প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহৃত কাঁকড়া ও কুচিয়া বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে রফতানিকৃত মৎস্যজাত পণ্যের প্রায় ৭০ শতাংশই ভ্যালু এ্যাডেড প্রোডাক্টস। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত আইকিউএফ, কুকড, ফিশ ফিলেট, ইত্যাদি ভ্যালু এ্যাডেড মৎস্যপণ্য রফতানি হয়ে থাকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া, চীনসহ বিশ্বের ৫২টি দেশে বাংলাদেশের মৎস্য ও মৎস্যপণ্য রফতানি করা হয়। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্ত্বেও সরকারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৪ হাজার ৪২ দশমিক ৬৭ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে ৫ হাজার ১৯১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা আয় হয়েছে, যা বিগত বছরের চেয়ে ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।
সূত্র জানায়, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, রফতানি বাণিজ্যের প্রসার মৎস্য খাতের অবদান দিন দিন বাড়ছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগ জোগান দিচ্ছে মাছ। মাথাপিছু প্রতিদিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে মানুষ এখন ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে। দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এখন মৎস্য খাতের অবদান। বিগত ১২ বছরে মৎস্য খাতে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট মাছের উৎপাদন ছিল ২৭ দশমিক ১ লাখ টন, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪৬ দশমিক ২১ লাখ টন। তার মধ্যে সামুদ্রিক মাছের অবদান ৬ দশমিক ৮১ লাখ টন, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। ২০১৭ সালে ‘বাংলাদেশের ইলিশ’ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই সনদ লাভ করেছে।
সূত্র আরো জানায়, বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ ৩য়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম, ইলিশ আহরণে ১ম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে ৪র্থ অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বে স্বাদু পানির মাছের ১১ শতাংশ এখন বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে। আর ইলিশ আহরণে বিশ্বে বাংলাদেশ রোল মডেল। শুধু ইলিশ থেকেই বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত মাছের ১২ দশমিক ২২ শতাংশ আসে। দেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক শতাংশের অধিক এবং একক প্রজাতি হিসেবে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ। ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার সরকারের ব্যাপক কর্মযজ্ঞের কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৬৫ লাখ টন ইলিশের আহরণ হয়েছে, যা ২০১০-১১ অর্থবছরে ইলিশের মোট উৎপাদনের (৩ দশমিক ৪০ লাখ টন) চেয়ে ৬৬ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। ইলিশের উৎপাদন ২০০৪-০৫ থেকে ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত গড়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ২০১৫ সালের পরে ২০১৯-২০ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক জলসীমায় ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এর মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উপকূলীয় জলাশয়ে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও সিউইড চাষের উদ্যোগ গ্রহণসহ সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই উন্নয়নে মৎস্য অধিদফতর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সাসটেইনেবল কোস্টাল এ- মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সর্বোত্তম আহরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আরভি মীন সন্ধানী নামক মৎস্য গবেষণা ও জরিপ জাহাজের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে এখন পর্যন্ত ৩৮টি সার্ভে ক্রুজ পরিচালনা করে ৪৫৭ প্রজাতির মৎস্য ও মৎস্যজাতীয় প্রাণী শনাক্ত করা হয়েছে। একই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মনিটরিং, কন্ট্রোল এ- সার্ভেল্যান্স (এমসিএস) ব্যবস্থা জোরদারকরণে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইথ ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ভেসেল মনিটরিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার আর্টিসিনাল নৌযান এবং ৫টি বাণিজ্যিক মৎস্য নৌযান ভেসেল মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় এসেছে। চট্টগ্রামে সামুদ্রিক সার্ভেল্যান্স চেকপোস্ট হতে জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সমন্বয়ে মনিটরিং, কন্ট্রোল এ- সার্ভিল্যান্স (এমসিএস) ব্যবস্থা জোরদারকরণে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জয়েন্ট মনিটরিং সেন্টার। তাছাড়াও সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মৎস্য আহরণের জন্য গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মৎস্য আহরণে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি