October 14, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, July 27th, 2022, 9:48 pm

বিসিকের পরিকল্পনার ত্রুটিতে ডুবছে দেশের ট্যানারি শিল্প

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) পরিকল্পনার ত্রুটিতে ডুবছে দেশের ট্যানারি শিল্প। বিপুল বিনিয়োগেও সাভারে চামড়া শিল্পনগরী সফলতা পাচ্ছে না। বরং ক্রমাগত দূষণ বেড়েই চলেছে। আর তার খেসারত দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের সময় বিসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী নিশ্চিত করা হয়েছে। আশ্বাস দেয়া হয়েছিল হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প স্থানান্তর হলে ইউরোপের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা যাবে। পাওয়া যাবে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ এবং চামড়ার দামও অনেক বেশি পাওয়া যাবে। আর ওসব আশ্বাস বিশ্বাস করেই ব্যবসায়ীরা হাজারীবাগ থেকে কারখানা স্থানান্তর করে। কিন্তু বাস্তবতা এখন উল্টো। কিন্তু সাভারে চরম ব্যর্থতার পরও বিসিক আরো দুটো চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনের কাজে হাত দিয়েছে। ট্যানারি শিল্প সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যদেশের অন্যতম রফতানিযোগ্য শিল্প। আরো রফতানি আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর জন্য ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। কিন্তু তাতেও শিল্পনগরীটি সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। বরং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথ না হওয়ায় সংসদীয় কমিটি সাভারের চামড়া শিল্পনগরী বন্ধ করে দেয়ার জন্য গত বছরের আগস্টে সুপারিশ করেছিল। তবে ওই সুপারিশ এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বিগত ১৯৫০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ট্যানারি শিল্পের বৃহৎ ঠিকানা ছিল রাজধানীর হাজারীবাগ। কিন্তু সেখানে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছিল না। ফলে লোকালয়ে দূষণ ছড়ানোর পাশাপাশি বুড়িগঙ্গাও দূষিত হচ্ছিল। এমন অবস্থায় শিল্প মন্ত্রণালয় হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরাতে ২০০৩ সালে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প হাতে নেয়। মোট ১২ দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই শিল্পনগরী তৈরি করা হয়। আর ২০১৭ সালে বিসিকের নেতৃত্বে হেমায়েতপুরে স্থানান্তর হয় ট্যানারি শিল্প। কিন্তু তখনো শেষ হয়নি সেন্ট্রাল অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্টের (সিইটিপি) কাজ। আর তাতে ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান সিইটিপি ছাড়াই কাজ শুরু করে। ফলে ধলেশ্বরীতে ট্যানারির দূষিত পানি মিশে নতুন শিল্পনগরীও আগের মতোই দূষণ ছড়াতে থাকে। সব মিলিয়ে বিপুল বিনিয়োগের পরও সাভারে চামড়া শিল্পের সফল ক্ষেত্র হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ব্যবসায়ীদের বিপুল বিনিয়োগও কাজে লাগেনি।
সূত্র জানায়, সাভারে বিসিকের চামড়া শিল্পনগরী ঘিরে নানা অব্যবস্থাপনা রয়েছে। সেখানে প্রায় ২০০ ট্যানারি কারখানার জন্য কোনো ধরনের ডাম্পিং স্টেশন নেই। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে রাখা হয়েছে। শিল্পনগরীর শেষ মাথায় বিশাল চামড়ার স্তূপ। দীর্ঘদিনের চামড়া পড়ে থাকায় মাটিও নষ্ট হয়ে গেছে। চামড়ার আবর্জনার বিশাল স্তূপর চাপে দেয়াল ভেঙে গেছে। বিসিক কোনো ধরনের সুবিধা না দিতে পারায় বিপাকে পড়েছে শিল্প মালিকরা। বিদ্যমান কারখানাগুলো থেকে বিসিকের সিইটিপির ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি পরিমাণ পানি নির্গত হয়। প্রতিটি কারখানায় যে ড্রেনেজ সিস্টেম রয়েছে তাও অপরিকল্পিত। হাজারীবাগে একেকটি ড্রেনের গভীরতা ছিল চার-পাঁচ ফুট। সাভারে তার অর্ধেকও নেই। ফলে ড্রেনগুলো পানিপ্রবাহের ভার সইতে পারছে না। যখন সিইটিপির নির্ধারিত ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি পানি ছেড়ে দেয়া হয় তখন সিইটিপির দায়িত্বরতরা ময়লা পানি সরাসরি নদীতে ফেলে দেয়। ফলে হাজারীবাগ থেকে নদীর দূষণ এড়াতে চামড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সাভার এলেও এখানেও নদী দূষণ হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াজাত পণ্য রফতানির জন্য এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট প্রয়োজন। ওই সংস্থাটির সনদ পাওয়ার প্রধান শর্ত হলোই আবেদন করা ট্যানারি পরিবেশ দূষণ করতে পারবে না। কিন্তু পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমাতে না পারায় সাভার চামড়া শিল্পনগরী এলডব্লিউজির সদস্য হতে পারেনি। ফলে বিদেশী ক্রেতারাও আসেনি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া বিক্রির পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। ফলে সাভার চামড়া শিল্পনগরী নিয়ে ব্যবসায়ীরা হতাশ। তাদের মতে, বলা হয়েছিল সাভারে গেলে ভালো দামে চামড়া বিক্রি করা যাবে এবং বিদেশী ক্রেতারা আসবে। কিন্তু এখন ব্যবসাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বিসিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নিয়ে কাজ করে। চামড়া শিল্প কখনোই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় পড়ে না। কারণ ওই শিল্পের একেকটি মেশিনের দামই ২ থেকে ৫ কোটি টাকা। একটি কারখানা স্থাপন করতে হলে অন্তত ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। আর তা কোনোভাবেই ক্ষুদ্র শিল্প নয়। বৃহৎ শিল্প যদি ক্ষুদ্র শিল্পের পরিকল্পনা দিয়ে চলে তাহলে তা কখনোই সফল হতে পারে না। সাভার চামড়া শিল্পনগরীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
এদিকে বিসিক সাভারে নানা ধরনের ভুল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর এবার আরো দুটি নতুন চামড়া শিল্পনগরীর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২০-২১) বলা হয়েছে, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে আরো দুটি চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনের প্রাথমিক কাজ চলমান। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওই দুটি চামড়া শিল্পনগরীর পরিকল্পনা হয়। ইতোমধ্যে প্রাথমিক সমীক্ষা শেষ হয়ে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। সাভারে ব্যর্থতার পর আরো চামড়া শিল্পনগরী তৈরি করা হলে তা রাষ্ট্রীয় অর্থেরই অপচয় হবে বলে অনেকের ধারণা। তাদের মতে, সাভারে চামড়া শিল্পের ব্যর্থতার পর নতুন শিল্পনগরীর কাজে হাত দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ জানান, শুরুর দিকে যে কোনো প্রতিষ্ঠানকেই ভুলত্রুটিসহ সুবিধা দিতে হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানই শতভাগ সঠিক হয়ে কাজ শুরু করতে পারে না। সেক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান তুলনামূলক কম পরিবেশ দূষণ করছে, মানমাত্রায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আছে, সরকার চাইলে তাদের পরিবেশ ছাড়পত্র দিতে পারে। কিন্তু ওই ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর সহযোগিতা করে না। সাভারে দেড়শর বেশি কারখানা আছে। সবার অবস্থা তো খারাপ না। সেগুলোর মধ্যে যারা ভালো করছে, সরকার চাইলে তাদের এগিয়ে নিতে পারে। এলডব্লিউজির জন্য মনোনীত হতে পারাও এ মুহূর্তে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের জন্য অনেক বড় বিষয়।
এ প্রসঙ্গে বিসিকের চেয়ারম্যান মুহ. মাহবুবর রহমান জানান, বিসিক চামড়া শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিসিকের পরিকল্পনায় ভুল ছিল কিনা বা সামনে ভুল হচ্ছে কিনা ওসব তো তাৎক্ষণিকভাবে বলার বিষয় নয়। কাগজপত্র দেখে যথার্থ অনুসন্ধান করে এ বিষয়ে জানাতে হবে।