অনলাইন ডেস্ক :
ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে বেশকিছু লুটপাটের ঘটনায় সিরীয় শরণার্থীদের জড়িত থাকার অভিযোগের পর তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন তুরস্কের নাগরিকরা। তুরস্কের ভূমিকম্পবিধ্বস্ত গ্রাম ও শহরগুলোর একাধিক বাসিন্দা সিরীয়দের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দোকান ও বাড়িতে চুরির অভিযোগ এনেছেন। টুইটারে ‘আমরা সিরীয়দের চাই না’, ‘শরণার্থীদের ফেরত পাঠাও’, ‘আর স্বাগত নয়’, এমন ভুরি ভুরি সিরীয়বিরোধী স্লোগান দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ভূমিকম্পে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া সিরীয় শরণার্থীরা বলছে, তাদেরকে জরুরি শিবিরগুলো থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্ণবাদী অপবাদের মুখোমুখি হওয়া স্বদেশিদের জন্য তুরস্কের মেরসিন শহরে একটি আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছেন এক সিরীয় নাগরিক। “আমরা উদ্ধারকাজ চলছে এমন স্থানগুলোতে যাওয়া বাদ দিয়েছি, কারণ লোকজন যখনই আমাদেরকে আরবি বলতে শোনে, তখনই চিৎকার করতে করতে তেড়ে আসে ও ধাক্কা দিতে থাকে। “তারা সবসময় আমাদেরকে লুটপাটের জন্য দোষারোপ করছে, কিন্তু এগুলো শুধু বিবাদ সৃষ্টির জন্য,” বলেছেন পরিচয় প্রকাশে রাজি না হওয়া এক সিরীয়। ৬ সেপ্টেম্বর, গত সোমবার স্থানীয় সময় ভোররাতে হওয়া ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা এরইমধ্যে ৩৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে; নিখোঁজ অসংখ্য মানুষকে জীবিত উদ্ধারের আশা ফিকে হয়ে যাওয়ায় এই সংখ্যা অনেক বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভয়াবহ এই ভূমিকম্প লাখ লাখ মানুষকে গৃহহীন করেছে; দুর্গত কিছুকিছু এলাকার বাসিন্দাদের খাবার ও জরুরি আশ্রয়ের জন্য কয়েকদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেক এলাকার বাসিন্দা ও ত্রাণকর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় লুটপাট হয়েছে বলে খবর দিয়েছেন; নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির কথা জানিয়ে একাধিক বিদেশি ত্রাণদল তাদের কাজ স্বল্প সময়ের জন্য বন্ধও রেখেছিল। লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছিল তুরস্কের বিচার মন্ত্রণালয়। আটককৃতদের জাতীয়তা বা তাদেরকে কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তা বলেননি তারা। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়িপ এরদোয়ান লুটপাটকারীদের কঠোর সাজা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। বাড়ছে উত্তেজনা। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দেশ ছেড়ে পালানো শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছিল তুরস্ক, দেশটিতে এখন প্রায় ৪০ লাখ সিরীয় শরণার্থীর বাস। এদের অধিকাংশই তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বসবাস করছেন। ওই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর গাজিয়ানতেপে প্রায় ৫ লাখ সিরীয় শরণার্থীর বাস, যা শহরটির মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। ভূমিকম্পে সিরিয়ার যেসব শহর ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গাজিয়ানতেপ তার অন্যতম। সিরীয়দের প্রতি তুর্কিদের ক্ষোভ নতুন নয়, কিন্তু ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি এই উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। তীব্র অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যেও এই সিরীয় শরণার্থীদের রাখতে গিয়ে ২০১১ সাল থেকে তুরস্কের ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি খরচ হয়েছে। অনেক তুর্কি নাগরিক সিরীয়দের দেখছেন সস্তা শ্রমিক হিসেবে, যারা তাদের চাকরি ও প্রাপ্ত সেবায় ভাগ বসাচ্ছেন। সিরীয় শরণার্থীদের ইস্যুটি চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা। “সিরীয়রা তাদের খালি ব্যাকপ্যাক নিয়ে আশপাশে হাঁটছে এবং দোকান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে ব্যাকপ্যাকে ভরছে। এখানে অনেকগুলো লুটের ঘটনা ঘটেছে,” বলেছেন দন্ত চিকিৎসক আহমেত, তিনি যে ভবনে সার্জারি করতেন সেই ভবনের ধ্বংসস্তূপের কাছে বসে ছিলেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক তুর্কি নাগরিককে ভূমিকম্প দুর্গতদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তাদের ভাষ্যেও আছে খোলামেলা সিরীয় বিরোধিতা। “ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়াদের এক বছরের জন্য আমার আঙ্কারার বাড়িতে স্বাগত জানাচ্ছি। শর্ত হচ্ছে, তারা সিরীয় হতে পারবে না,” কাঠের তৈরি একটি বাড়ির ছবিসহ করা এক টুইটে এমনটিই বলা হয়েছে। আরও যারা ত্রাণ বা অস্থায়ী আবাসস্থল দেওয়ার কথা বলছেন, তাদেরও একই শর্ত। সিরিয়ার সাবেক সরকারবিরোধী রাজনীতিক মুস্তাফা আলি এখন মেরসিনে প্রায় আড়াইশর মতো সিরীয়র জন্য একটি অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র চালাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, বাস্তুচ্যুত তুর্কিদের কাছ থেকে এ সিরীয়দের আলাদা রাখার ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অবস্থানে তিনি সম্মত। “সংস্কৃতি, জীবনাচরণ, ভাষা আলাদা। দুই পক্ষকে আলাদা করে রাখা সম্ভবত অনেক সমস্যার সমাধান এনে দেবে। শুরুর দিকে অনেক আশ্রয়কেন্দ্রই লোকজনকে তারা তুর্কি নাকি বিদেশি, তা জিজ্ঞাসা করেনি। কিন্তু পরেরদিন, যথন কিছু ঝামেলা সৃষ্টি হল, কিছু জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য এল, ভাবলাম কিছু সমস্যা সৃষ্টি হলেও হতে পারে, যা আলাদা থাকলে হবে না,” বলেছেন তিনি। আলির ওই আশ্রয়কেন্দ্রের আ শ্রিতদের মধ্যে একজন ৩৫ বছর বয়সী বিলাল আল-শেখ; ইসকানদেরুন শহরে থাকা বাড়ির ছাঁদ ধসে পড়ার পর তিন সন্তানকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে ছুটেছিলেন তিনি। “আমরা একটি যৌথ আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলাম, সেখানে এক-দুই দিন ছিলাম, এখন এখানে। আগের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সময় এক রাতে বাচ্চারা ঘুমি ছিল, লোকজন এসে বলল, তোমাদেরকে অন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে। প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, আমরা ভুগেই যাচ্ছি,” বলেছেন বিলাল। অনেক সিরীয়ই প্রাথমিকভাবে মনে করেছিল, তুরস্কের মাধ্যমে তারা ইউরোপে নতুন জীবন শুরু করতে পারবেন। কিন্তু আঙ্কারা ইউরোপ অভিমুখে যাওয়া শরণার্থীদের ঢল রোধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর তারা সেখানেই আটকা পড়ে যান। সিরিয়ার অনেকেই তুরস্কে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবস্থান করছেন। তারা ভূমিকম্পে মাথার ওপরের ছাঁদ হারানোর পরও সাহায্যের জন্য কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হতে ভয় পাচ্ছেন; তাদের আশঙ্কা, খোঁজ পেলে কর্তৃপক্ষ তাদেরকে হয়তো দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু গত সোমবার বলেছেন, “ভূমিকম্পের পর সিরিয়া থেকে শরণার্থীদের নতুন আরেকটি ঢেউ তুরস্কে আসছে বলে যে কথা শোনা যাচ্ছে, তা সত্য নয়। এটা অবান্তর।”
আরও পড়ুন
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২
তীব্রতর হচ্ছে ইসরায়েলি হামলায় লেবাননে যুদ্ধ
হারিকেন হেলেনে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৯০ জনের মৃত্যু