নিজস্ব প্রতিবেদক:
মানসিক সমস্যায় ভুগছে দেশের হাসপাতালগুলোতে কর্মরত অধিকাংশ নার্স। বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্যখাতে নার্স সঙ্কট প্রকট। এমন পরিস্থিতিতে নার্সরা কাজের বাড়তি চাপ নিয়েই হাসপাতালগুলোতে সেবা দিচ্ছে। পাশাপাশি তাদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈরিতা, উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, রোগীর স্বজনদের দুর্ব্যবহার, প্রাতিষ্ঠানিক অস্বচ্ছতা, পদোন্নতির ঘাটতিসহ কর্মক্ষেত্রে নানা পরিস্থিতিে মোকাবেলা করতে হয়। আর এমন নানামুখী চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। ফলে স্বাস্থ্য খাতের অপরিহার্য ওই কর্মী বাহিনীর অধিকাংশকেই নানামুখী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত নার্স রয়েছে মাত্র ৪৮ হাজার। অথচ প্রয়োজন ৩ লাখেও বেশি। প্রতি চিকিৎসকের বিপরীতে ৩ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও মাত্র রয়েছে মাত্র দশমিক ৩০ জন। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে ২৩ জন নার্স থাকার কথা কথা থাকলেও বাংলাদেশে ওই সংখ্যা ৩ জন। অথচ স্বাস্থ্যসেবা একটি দলগত প্রচেষ্টার প্রধান চিকিৎসক আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হলো নার্স। চিকিৎসকরা রোগীর রোগের ধরন এবং কী ধরনের চিকিৎসা লাগবে তা নির্ধারণ করে আর নার্সরা ওই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে। সেজন্য নার্সদের পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি রোগীর সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতে শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য এবং সামাজিকভাবে সুস্থ থাকা জরুরি। মানসিক সুস্বাস্থ্য বিঘিœত নার্সদের সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন ব্যাহতের আশঙ্কা বাড়ে। সেজন্যই পৃথিবীর সব দেশেই চিকিৎসক ও নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, অনুপযুক্ত পরিবেশে কাজ করছে দেশের ৮৬ শতাংশ নার্স। কোলাহলমুখর, স্বল্প আলো, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও অপর্যাপ্ত বায়ুপ্রবাহের মধ্যেই তারা দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছে। অথচ কর্মজীবনে ৭০ শতাংশ নার্সই পদোন্নতি পায় না। ১০ থেকে ২০ বছর ধরে পদোন্নতি না পাওয়া ওসব স্বাস্থ্যসেবা কর্মী নার্সিং পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। এক পদে থেকেই বহু নার্সই অবসরে গেছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে তাদের পেশাগত চাপ তৈরি হয়। যা তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে। দেশের ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞদের পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, পেশাগত কাজ করতে গিয়ে উদ্বেগ ও বিষণœতার মতো মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে ৫১ শতাংশ নার্স। ৬০ শতাংশ নার্স মানসিকভাবে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে দিন পার করছে। শারীরিক বা পরিবেশগতভাবে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে ৪২ শতাংশ। সামাজিকভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম যুক্ত হতে পেরেছে মাত্র ৪৮ শতাংশ নার্স। আর ২০ শতাংশের মধ্যে বিষণœতা কাজ করছে। গবেষকরা নার্সরা কর্মক্ষেত্রে কী অবস্থায় কাজ করছে, মানসিক স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে তাদের অবস্থা কেমন তা দেখার চেষ্টা করেছে। এমনিতেই দেশে রোগীর সংখ্যার অনুপাতে খুবই কম নার্সের সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করা হলে স্বাস্থ্যসেবায় তাদের ভূমিকা নেতিবাচক হওয়ার শঙ্কা বাড়ে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ-সেমিনারসহ কর্মপরিধি বাড়ানো জরুরি।
সূত্র আরো জানায়, অতিরিক্ত চাপের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই বাংলাদেশে অধিকাংশ নার্স মানসিক নানা জটিলতায় ভুগছে। বিষণœতা-উদ্বেগ ও চাপ নিয়েই তারা সেবা দিচ্ছে। নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হওয়ার পাশাপাশিনার্সদের যে পরিমাণ রোগী নিয়ে কাজ করার কথা, তার চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি রোগী নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। পদ-পদবি ও ভবিষ্যৎ নিয়েও নার্সদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এখনো নার্সিং ও মিডওয়াইফদের কোনো চূড়ান্ত অর্গানোগ্রাম হয়নি। পদোন্নতির সংখ্যাও খুবই কম। তবে নার্সিংয়ে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করা হয়েছে এবং তা প্রশাসনিক অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ওই কারিকুলাম চালু হলে নার্সরা নিজেদের ও অন্যের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা মনে করছে।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যে গুরুত্ব দেয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। নার্সদের কাজের চাপ ও কর্মঘণ্টা হ্রাস এবং যথাযথ পরিমাণে সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক কার্যক্রমেও নার্সদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নার্সদের যেমন মর্যাদা রয়েছে এদেশে তেমন নেই। সামাজিকভাবেও নার্সরা অবমূল্যায়িত। সামাজিকভাবে ক্ষমতাবানরা তাদের কিছুটা তাচ্ছিল্যের চোখেও দেখে। অথচ নার্সরা ভালো না থাকলে রোগীও ভালো সেবা পাবে না। সেজন্য পর্যাপ্ত নার্স নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর যথাযথ পদায়নের জায়গা নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে সার্বিক বিষয়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. নাসির উদ্দিন জানান, প্রয়োজনের তুলনায় নার্সদের সংখ্যা কম হওয়ায় তাদের ওপর কাজের চাপ বেশি। তাছাড়া পছন্দের জায়গায় পদায়ন নিয়েও কিছুটা চাপ নার্সরা অনুভব করতে পারে। কারণ অনেকের স্বামী-সন্তান ভিন্ন জায়গায় থাকে। অনেক নার্সকেই তাদের কাক্সিক্ষত জায়গায় দেয়া যাচ্ছে না। কারণ তারা যেসব জায়গায় যেতে চান সেখানে হয়তো পদ খালি বা চাহিদা নেই। বর্তমানে প্রায় শেষ পর্যায়ে নতুন করে আরো ১০ হাজার নার্স নিয়োগের কার্যক্রম। আরো ৪ হাজার নার্স নিয়োগের চাহিদা দেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি