নিজস্ব প্রতিবেদক:
বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা। পল্টন মোড়ের চারদিকের রাস্তা স্থবির। সকাল ১০ টা থেকে এমন অবস্থা চলছিল বলে জানালেন ওই এলাকার কয়েকজন দোকানদার ও পথচারী। এই সময় বিজয় নগর মোড়, গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট, দোয়েল চত্বর, দৈনিক বাংলা মোড় সব জায়গায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ঢাকার রাস্তায় নামলেই যানজটে কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে এটা ধরে নিয়েই পথে বের হতে হয় সবাইকে। যানজটের কারণ খুঁজলে দেখা যায়, সড়ক দখল করে অবৈধভাবে পার্কিং করে রাখা হচ্ছে বাস, ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি, হিউম্যান হলার, রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, ঢাকায় ৩০ শতাংশ যানজটের জন্য দায়ী অবৈধ গাড়ি পার্কিং। মিরপুর-১, ১০ নম্বর চত্বরের আশপাশ, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, উত্তরা, মহাখালী, তেজগাঁও, বনানী, বাড্ডা, গুলিস্তান, মতিঝিল, নয়াপল্টন, সায়েদাবাদ, গুলশানসহ এমন কোনো এলাকা নেই, যেখানে অবৈধ পার্কিং করা হয় না। শুধু তাই নয়, শহরের মূল সড়কের বাইরে ছোট ও মাঝারি প্রায় প্রতিটি সড়কেই অবৈধ পার্কিং করা হয়। রাজধানীর পার্কিং নৈরাজ্য কমাতে ২০০৭ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল।
তবে ২০২২ সালে এসেও তা আলোর মুখ দেখেনি। হয়নি নীতিমালাও। বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে থেকে শুরু করে রেলভবনের শেষপ্রান্ত ও প্রেসক্লাব পর্যন্ত সড়কের ওপর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি, ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নটর ডেম কলেজের সামনের সড়কে প্রাইভেটকার, বাস-ট্রাক, লরিসহ নানা ধরনের যানবাহন পার্কিং করে রাখা হয়। বক চত্বরের আশপাশে সড়কে ব্যক্তিগত পাড়ি পার্কিং বেশী দেখা যায়। যদিও মতিঝিলে সাধারণ বীমা অফিসের উল্টো দিকে সিটি করপোরেশন একটি বহুতল ভবনে ৩৭০টি গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা করেছে। এর পাশাপাশি ৩৭ তলা সিটি সেন্টারেও প্রায় সাড়ে ৫০০টি গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে গাড়ির তুলনায় পার্কিং সংখ্যা সামান্য।
ধানমন্ডি রাজধানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এখানে রয়েছে বেশ কিছু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, অফিস, রেস্তোরাঁ এবং বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থান। তাই সবসময় মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। ধানমন্ডির প্রধান সড়কে দেখা যায়, অবৈধ জায়গায় প্রাইভেটকার ও বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের মেলা। ফুটপাত গুলোও দখল করে আছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রিং রোডের অধিকাংশ অংশ জুড়েই দখল হয়ে আছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং ও আদাবর থানার ডাম্পিং করা যানবাহনে। এতে মানুষের চলাচলসহ বাস ও অন্যান্য যানবাহন চলাচলে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শ্যামলী স্কয়ার থেকে মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ মোড় পর্যন্ত রিং রোডের রাস্তার অবস্থা বেহাল ছিল।
উত্তর সিটি করপোরেশন এ রাস্তাটি সুপ্রশস্ত করে উন্নয়ন করে ফুটপাত তৈরী করলেও তার সুফল পাঁচ্ছে না মানুষ। উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে তারা কয়েক দিন পরপর রাস্তাটির অবৈধ পার্কিং এর বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে, তবে সমাধান মিলেনি এতে। গতবছর রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকার বেশির ভাগ ফুটপাত নতুন করে তৈরির কাজ শেষ করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এই অঞ্চল দিয়ে চলাচলকারী মানুষের আশা ছিল এবার তারা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারবে। তাদের সেই আশার গুড়েবালি। রাস্তা ও ফুটপাত উন্নত হলেও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামনে গড়ে ওঠা অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে বেশ কয়েকটি জায়গায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। প্রতিষ্ঠানগুলো রাস্তার একটি অংশে দখল করে তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ও স্টাফ বাস পার্ক করে রাখে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত। এ কারণে দুই লেনের এই রাস্তা সরু হয়ে এক লেনে পরিণত হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এ ছাড়া ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে শুরু করে কারওয়ান বাজার, কারওয়ান বাজারের আশপাশ, কারওয়ান বাজার থেকে শুরু করে মোতালেব প্লাজা হয়ে এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল ও কাঁটাবন হয়ে নীলক্ষেত পর্যন্ত রাস্তার ওপর নানা ধরনের যানবাহন পার্কিং করে রাখা হয়।
একই অবস্থা ফার্মগেট থেকে সিটি কলেজ মোড় পর্যন্ত। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর অধিকাংশ ভবনের নেই পার্কিং-এর ব্যবস্থা। বড় বিপণি বিতানগুলোতে পার্কিং ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে অন্তত ১৫ হাজার বহুতল ভবনে নেই পার্কিং সুবিধা। ফ্ল্যাট অনুপাতে আরও লক্ষাধিক বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা নেই। ফলে ব্যস্ত সড়কের উপর অবৈধভাবে বাড়ছে গাড়ি পার্কিং। এতে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এসব অবৈধ পার্কিং নগরবাসীর জীবনে বিষফোঁড়া হয়ে উঠছে। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ৪৭ ধারায় বলা আছে, সরকার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক পুলিশের পরামর্শে মোটরযান পার্কিং এলাকা নির্ধারণ করতে পারবে। নির্ধারিত এলাকা ছাড়া পার্কিং করা যাবে না, যদি কেউ করে তা হবে অপরাধ। এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদ-ে দন্ডিত করা যাবে। একই সঙ্গে চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কর্তন করা হবে। যদিও এখন পয়েন্ট কাঁটার নিয়ম কার্যকর নেই।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন রাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের বিনিময়ে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নাম ভাঙিয়ে স্লিপ দিয়ে টাকা তোলা হয়। যদিও সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করে থাকেন তারা কাউকে টাকা তোলার জন্য রাস্তা লীজ দেননি। জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ হয়ে এই টাকা তোলা হলেও এর কিছু অংশ পায় দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। বাকী টাকা যায় স্থানীয় সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশের পকেটে। তাই অবৈধ পার্কিং নিয়ে মাথাব্যথা নেই সংশ্লিষ্টদের। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, পার্কিং নীতিমালা তৈরি করা উচিৎ। নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে পার্কিং নিশ্চিত করতে হবে।
তবে রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনের দাবি, তারা চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে যে যানজট সৃষ্টি হয়, সেটা আমরাও জানি। কিন্তু যেসব এলাকায় পার্কিংয়ের জায়গা নেই, সেখানকার মানুষ কোথায় গাড়ি পার্কিং করবে? এটা তো একটা সমস্যা। আবার আমরা কঠোর হলে তো দেখা যাবে অনেক অফিসের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন তো একটা প্রভাব পড়বে। আসলে পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের অবকাঠামো তৈরি না করলে এই সমস্যার আপাতত কোনো সমাধান হবে না।’
আরও পড়ুন
কয়লার সংকটে পায়রা পাওয়ার প্ল্যান্টের কার্যক্রম বন্ধ
নওগাঁয় ট্রাক ও সিএনজির মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ৪, আহত ১
ঢাকায় এসেছেন ভারতীয় সেনাপ্রধান