অনলাইন ডেস্ক :
শেষ বলে সীমানায় আন্দ্রে রাসেলের ক্যাচ নিয়ে গ্যালারির দিকে তাকিয়ে ঠোটেঁ আঙুল চেপে কুমিল্লার সমর্থকদের চুপ করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলেন ইয়াসির আলি। তার সতীর্থরা তখন মাঠে মেতে উঠেছে উল্লাসে। তাদের ডাগআউটে তখন চলছে খ্যাপাটে উদযাপন। টুর্নামেন্টে তাদের মূল চাওয়া-পাওয়ার পালা চুকে গেছে আগেই। কিন্তু সবার বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসই বলে দিচ্ছিল, এই জয়ের ওজন কতটা। তারকায় ঠাসা চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে জয় বলে কথা! শক্তি-সামর্থ্যে দুই দলের পার্থক্য বিশাল ছিল আগে থেকেই। এই ম্যাচে সেই ব্যবধান আকাশ-পাতাল হয়ে ওঠে কুমিল্লা আন্দ্রে রাসেল ও সুনিল নারাইনকে পাওয়ায়। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে সিলেট ঘুচিয়ে দিল সেই ব্যবধান। কুমিল্লার অধিনায়ক লিটন কুমার দাস যদিও খেললেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। কিন্তু ম্যাচ জয়ের হাসি মোহাম্মদ মিঠুন ও তার দলের। বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে ১২ রানে হারাল সিলেট স্ট্রাইকার্স।
চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে সোমবার সিলেটের ১৭৭ রান তাড়ায় কুমিল্লা যেতে পারে ১৬৫ পর্যন্ত। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সিলেটের জয়ের নায়ক বেনি হাওয়েল। আগের ম্যাচে ফিফটি করা অলরাউন্ডার আবারও দলের বিপর্যয়ের মধ্যে উপহার দেন ৬ চার ও ৪ ছক্কায় ৩১ বলে ৬২ রানের ইনিংস। তার ২১৬ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ স্কোর এটিই। পরে বল হাতে শেষ সময়ে মইন আলির গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নেন তিনি। রান তাড়ায় ওপেন করতে নেমে শেষ ওভারে বিদায় নেওয়া লিটন করেন ৫৮ বলে ৮৫ রান। কিন্তু তা যথেষ্ট হয়নি দলের জয়ের জন্য। হাওয়েলের ঝড়ে সিলেট শেষ ৫ ওভারে তোলে ৬৯ রান। শেষ ৫ ওভারে কুমিল্লার প্রয়োজন ছিল ৬১।
লিটন তখন থিতু, ক্রিজে তার সঙ্গী জনসন চার্লস। বাইরে তখনও অপেক্ষায় রাসেল, মইন, নারাইন, জাকের আলির মতো বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু তারকায় ঠাসা সেই ব্যাটিং লাইন আপ পারেনি শেষ সময়ের সেই দাবি মেটাতে। রাসেলদের ওপর বেশি নির্ভরতার কারণেই কি না, শেষ দিকে পর্যাপ্ত স্ট্রাইকও পাননি লিটন। সিলেটের হয়ে শেষ দিকে গতি-বৈচিত্র মিলিয়ে দুর্দান্ত বোলিং করে বাঁহাতি পেসার শফিকুল ইসলাম। শুরুর দিকে রান আটকানোর কাজটি দারুণভাবে করেন সামিত প্যাটেল। লিটনের শুরুটা ছিল মন্থর। তাদের দলের শুরুটাও ভালো ছিল না। ওপেনিংয়ে ফেরা ইমরুল কায়েস বিদায় নেন ৩ রানে। তাওহিদ হৃদয় ক্রিজে যাওয়ার পরপরই বিশাল এক ছক্কা মারেন সানজামুল ইসলামকে। তবে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যান পরে আর ডানা মেলতে পারেননি। আউট হয়ে যান ১৫ বলে ১৭ করে। এরপর চার্লস গিয়েও ধুঁকতে থাকেন। ৯ ওভারে কুমিল্লার রান ছিল ২ উইকেটে ৫৫।
লিটন খেলছেন তখন ২৬ বলে ২২ রান নিয়ে। দশম ওভারে হাত খোলেন তিনি আরিফুল হককে পেয়ে। তিন চার ও এক ছক্কায় ওই ওভার থেকে ২২ রান নেন কুমিল্লা অধিনায়ক। পরের ওভারে ফিফটি পূর্ণ করেন ৩৬ বল খেলে। আসরের প্রথম সাত ম্যাচে ফিফটি না পাওয়া ব্যাটসম্যান তিন ম্যাচের মধ্যে পেলেন দুই ফিফটি। তবে তার মূল কাজ তখনও বাকি। সেই চেষ্টায় ছুটে ছক্কা ও চার মারেন তানজিম হাসানের এক ওভারে। চার্লস সহজ ক্যাচ দিয়ে বেচে যাওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত ২১ বলে ১২ রান করে বিদায় নেন। লিটন স্লগ করে ছক্কায় ওড়ান হাওয়েলকে। তবে ওই ওভারেই স্লগের চেষ্টায় মইন আলি বোল্ড হয়ে যান শূন্য রানে। এরপর কুমিল্লা তাকিয়ে ছিল রাসেলের দিকে। ১৯তম ওভারে হাওয়েলকে একটি ছক্কা ও চার মারেন ক্যারিবিয়ান তারকা।
কিন্তু ওভারের তিনটি বল থেকে রান নিতেও ব্যর্থ হন তিনি। তাতে শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ২৫ রানের। তানজিমের করা ওভারের প্রথম বলেই তেড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে বল স্টাম্পে টেনে আনেন লিটন। নতুন ব্যাটসম্যান জাকের আলি ক্রিজে গিয়েই ছক্কা মেরে দেন লং অন দিয়ে। পরের বলে হয় ওয়াইড, এরপর সিঙ্গেল। চতুর্থ বলে আবার রান নিতে ব্যর্থ হন রাসেল। পরে একটি বাউন্ডারি মেরে আউট হয়ে যান তিনি শেষ বলে। জয়োল্লাসে মেতে ওঠে সিলেট। ম্যাচের শুরুতে সিলেট ব্যাটিংয়ে নামে টস জিতে। নিস্তরঙ্গ প্রথম দুই ওভারের পর তৃতীয় ওভার থেকে শট খেলতে শুরু করেন জাকির হাসান ও সদ্যই দলে যোগ দেওয়া কেনার লুইস। আলিস ইসলামের ওভার থেকে দুজন মিলে নেন ১৮ রান। পরের ওভারে মইন আলিকে দুটি বাউন্ডারি মারেন জাকির। ষষ্ঠ ওভারে বোলিংয়ে এসেই এই জুটি থামান সুনিল নারাইন।
কিংবা বলা ভালো, থেমে যান জাকির নিজেই। নারাইনের প্রথম বলেই স্লগ করতে গিয়ে বোলারের হাতেই ধরা পড়েনি তিনি (১৭ বলে ১৮)। উইকেট মেডেন নিয়ে এবারের বিপিএল শুরু করেন নারাইন। দুঃসময়ের বলয়ে থাকা শান্ত যথারীতি উইকেট গিয়ে ধুঁকতে থাকেন। আরেকপ্রান্তে লুইস বাড়াতে থাকেন রান। তবে দ্রুত তিন উইকেট নিয়ে দারুণভাবে ম্যাচে ফেরে কুমিল্লা। এবারের আসরের প্রথম দিনে ১ ওভারে ১৯ রান দেওয়ার পর একাদশে জায়গা হারানো মুশফিক হাসান এবার একাদশে ফিরে শুরুটা করেন দারুণ। ১৪০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যান তিনি বেশ কয়েকবার। ২৫ বলে ৩৩ রান করা লুইসকে বিদায় করে দেন তরুণ এই পেসারই।
একাদশে ফেরা আরেক বোলার রিশাদ হোসেন পরের ওভারে জোড়া ধাক্কায় আরও নাড়িয়ে দেন সিলেটকে। দুটিই অবশ্যই ব্যাটসম্যানদের উপহার। বাজে সময়কে আরও দীর্ঘায়িত করে শান্ত ১৮ বলে ১২ রানে বোল্ড হন স্লগ সুইপের চেষ্টায়। অনেক বাইরের বলে আলগা শটে বিদায় নেন একাদশে ফেরা ইয়াসির আলি (২)। উইকেটে পেছনে দারুণ ক্যাচ নেন লিটন। ৭ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারায় সিলেট। সেই দুর্যোগ থেকে দলকে উদ্ধার করেন হাওয়েল। চাপের মধ্যেও পাল্টা আক্রমণের পথ বেছে নেন তিনি। মুশফিককে চার দিয়ে শুরুর পর ছক্কা ও চার মারেন তিনি রিশাদের ওভারে, টানা দুই বলে ছক্কা-চার মারেন আন্দ্রে রাসেলকে। শুরুতে হাওয়েলকে স্রেফ সঙ্গই দেন মিঠুন।
পরে তিনিও দুটি ছক্কা মারেন রিশাদের এক ওভারে। ওই ওভারে হাওয়েলের আরেকটি ছক্কাসহ রান আসে মোট ২৪। নারাইনের দ্বিতীয় শিকার হয়ে মিঠুন (২০ বলে ২৮) ফিরে গেলেও হাওয়েলকে থামাতে পারেননি কেউ। ২৫ বলে ফিফটি ছোঁয়ার পর শেষ ওভারেও মুশফিককে ছক্কা ও চার মারেন তিনি টানা দুই বলে স্কুপ ও র্যাম্প শটে। ছাড়িয়ে যান এই সংস্করণে নিজের আগের সর্বোচ্চ ৫৭ রানকে, ২০১৫ সালে যে ইনিংসটি তিনি খেলেছিলেন গ্লস্টারশায়ারের হয়ে। আগের দিন অনুশীলনে মাথায় চোট পাওয়া মুস্তাফিজুর রহমানকে এই ম্যাচে পায়নি কুমিল্লা। শেষ ৬ ওভারে ৮০ রান তোলে সিলেট। শেষের সেই ঝড়ই শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দেয় ম্যাচে। প্লে অফের লড়াই থেকে আগেই ছিটকে পড়া সিলেটের এটি দশম ম্যাচে চতুর্থ জয়। কুমিল্লা হারল টানা পাঁচ জয়ের পর। ১০ ম্যাচে তাদের হার তিনটি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
সিলেট স্ট্রাইকার্স: ২০ ওভারে ১৭৭/৫ (লুইস ৩৩, জাকির ১৮, শান্ত ১২, ইয়াসির ২, মিঠুন ২০, হাওয়েল ৬২*, আরিফুল ৭*; রাসেল ৪-০-৩৫-০, মইন ২-০-১৩-০, আলিস ৩-০-৩৮-০, নারাইন ৪-১-১৬-২, মুশফিক ৪-০-৩২-২, রিশাদ ৩-০-৩৭-২)।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স: ২০ ওভারে ১৬৫/৬ (ইমরুল ৩, লিটন ৮৫, হৃদয় ১৭, চার্লস ১২, মইন ০, রাসেল ২৩*, জাকের ৭*; আরিফুল ২-০-৩৬-০, সামিত ৪-০-১৫-১, শফিকুল ৪-০-১৮-১, সানজামুল ৩-০-২৫-০, তানজিম ৩-০-৩৩-৩, হাওয়েল ৪-০-৩৬-১)।
ফল: সিলেট স্ট্রাইকার্স ১২ রানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: বেনি হাওয়েল।
আরও পড়ুন
কানপুর টেস্টে মুমিনুলের সেঞ্চুরি, বাংলাদেশের সংগ্রহ ২৩৩ রান
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার বিয়য়ে যা বললেন তামিম
অক্টোবরে বাংলাদেশে সফরে আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা