October 8, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, March 12th, 2023, 8:48 pm

সৌদি-ইরান চুক্তিতে উদ্বিগ্ন ইসরায়েল, সতর্ক মধ্যপ্রাচ্য

অনলাইন ডেস্ক :

দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের খবরে শনিবার মধ্যপ্রাচ্যকে আলোড়িত করেছে। এটিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য একটি প্রতীকী ব্যর্থতা হিসেবেও দেখা হচ্ছে। নেতানিয়াহু, যিনি ইরানের হুমকিকে নিজের কূটনীতির অগ্রাধিকার ও ব্যক্তিগত ধর্মযুদ্ধে পরিণত করেছেন। এই অগ্রগতি এক বছরের বেশি সময় ধরে আলোচনার ফলে এসেছে। শুরুতে বাগদাদ এবং সম্প্রতি চীনে দুই দেশের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এই চুক্তি ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও উত্তপ্ত করেছে। যা দেশটির বিশৃঙ্খল সময়ে আরও বিভাজনের প্রতিফলন। চুক্তির আওতায় ইরান ও সৌদি আরব দুই মাসের মধ্যে দূতাবাস চালু করবে এবং সাত বছর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন থাকার পর তা পুনঃস্থাপন করবে। গত কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতির সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এই এই ঘটনা। সুন্নি সৌদি আরব ও শিয়া ইরানের ক্ষমতার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পরিণত হওয়া সিরিয়া ও ইয়েমেনের মতো দেশগুলো এই ঘোষণায় সতর্কতার সঙ্গে ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে। ইসরায়েলে এই চুক্তি হতাশার জন্ম দিয়েছে-একই সঙ্গে অনেকে নেতানিয়াহুর দিকে আঙুল তুলছেন। নেতানিয়াহুর পররাষ্ট্রনীতির বড় সফলতার মধ্যে একটি হলো ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় চারটি আরব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। এই চারটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে আরও বিচ্ছিন্ন ও দেশটির বিরোধিতার অংশ ছিল এই সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। তেহরানের ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক কর্মসূচি এবং ইরানপন্থী লেবাননের হেজবুল্লাহ ও গাজা উপত্যকার হামাস থেকে ইসরায়েলকে রক্ষায় সক্ষম একমাত্র নেতা হিসেবে নিজেকে হাজির করছেন নেতানিয়াহু। ইসরায়েল ও ইরান একটি আঞ্চলিক ছায়াযুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধের অংশ হিসেবে পারসিয়ান উপসাগরে পণ্যবাহী ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট জাহাজে ইরান ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ধনী আরব দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি হতে পারত নেতানিয়াহুর বড় সাফল্য। এতে করে অঞ্চলটিতে নতুন মেরুকরণ হতো এবং ইসরায়েলের অবস্থান শক্তিশালী করত। যদিও পর্দার আড়ালে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে রিয়াদ বলেছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধান হওয়ার আগ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে না তারা। গত বছরের শেষ দিকে ক্ষমতায় ফেরা নেতানিয়াহু ও তার মিত্ররা ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে, সৌদি আরবের সঙ্গে একটি চুক্তি হওয়ার পথে রয়েছে ইসরায়েল। গত মাসে মার্কিন ইহুদি নেতাদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে নেতানিয়াহু একটি শান্তিচুক্তিকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ইরানকে ঠেকানো সমান্তরালে কাজ করার লক্ষ্য। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুক্রবার ঘোষিত ইরান-সৌদি চুক্তি নেতানিয়াহুর এই উচ্চাকাক্সক্ষায় জল ঢেলে দিয়েছে। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সৌদি সিদ্ধান্তে ইসরায়েল মূলত একা হয়ে পড়েছে। কারণ ইরানকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছিলো তারাই। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সামরিক হামলার পক্ষেও একাই সওয়াল করছে দেশটি। এর আগে গত বছর ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইসরায়েলি থিংক ট্যাংক ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি-এর পারস্য উপসাগরীয় বিশেষজ্ঞ ইয়োয়েল গুজানস্কি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে এই অঞ্চলে ইরান-বিরোধী ব্লক গঠনের চেষ্টায় ইসরায়েলের ধারণা ও প্রচেষ্টার ওপর এটি একটি আঘাত। মধ্যপ্রাচ্যকে ‘জিরো-সাম গেম’ হিসেবে বিবেচনা করলে ইরানের একটি কূটনৈতিক জয় ইসরায়েলের জন্য বড় দুঃসংবাদ। নেতানিয়াহুর একজন মিত্র ও জাতিসংঘে ইসরায়েলের দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ড্যানি ড্যান মনে করেন, ২০২৩ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে শান্তিচুক্তি প্রায় ভেস্তে গেছে। এটি আমাদের উদ্যোগের পক্ষে সহায়ক না। সৌদি আরব ও ইরানের দ্বন্দ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইয়েমেন। দেশটিতে সংঘাতরত দুই পক্ষ সতর্ক, কিন্তু আশাবাদী। ২০১৪ সালে ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা। এরপর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি সরকার সৌদি আরবে নির্বাসিত হয়। ২০১৫ সালে ইয়েমেন সংঘাতে হস্তক্ষেপ করে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট। হুথি বিদ্রোহীরা এই চুক্তিকে পরিমিত কিন্তু ইতিবাচক বলে স্বাগত জানিয়েছে। মুখপাত্র ও প্রধান মধ্যস্থতাকারী মোহাম্মেদ আব্দুলসালাম বলেন, অঞ্চলের দেশগুলোর উচিত স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরে আসা। এর মাধ্যমে বিদেশি হস্তক্ষেপে হারিয়ে যাওয়া সুরক্ষা পুনরুদ্ধার করতে পারবে ইসলামি সমাজ। সৌদি আরব সমর্থিত ইয়েমেনের সরকারও একই ধরনের আশাবাদ এবং সতর্কতার কথা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইয়েমেন সরকারের অবস্থান নির্ভর করে কাজে ও পদক্ষেপে, শব্দ ও দাবিতে নয়। ইরানের আচরণে সত্যিকার পরিবর্তন আসার আগ পর্যন্ত তারা সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। বিশ্লেষকরা খুব শিগগিরই এই সংঘাতের অবসান হবে বলে মনে করছেন না। কিন্তু তারা বলছে, সরাসরি আলোচনা ও ভালো সম্পর্ক পৃথক চুক্তির সুযোগ দিতে পারে। যার ফলে উভয়দেশ বিপর্যয়কর যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে। ওয়াশিংটনভিত্তিক আরব সেন্টারের অনাবাসিক গবেষক আফরাহ নাসের বলেন, বল এখন ইয়েমেনে সংঘাতে লিপ্ত পক্ষের কাছে। তাদেরকে ইয়েমেনের জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে এবং প্রাথমিক ইতিবাচক পদক্ষেপে অনুপ্রাণিত হতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের উপসাগরীয় বিশ্লেষক আনা জ্যাকবস মনে করেন, ইয়েমেনে উত্তেজনা নিরসনের সঙ্গে ইরান-সৌদি চুক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তার কথায়, ইয়েমেন সংঘাত অবসানে ইরানের পক্ষ থেকে আশ্বাস ছাড়াই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও দুই মাসের মধ্যে দূতাবাস চালু করার কথা কল্পনা করা কঠিন। সিরিয়াও একইভাবে চুক্তিটিকে স্বাগত জানিয়েছে। এটিকে তারা দেশটির সংঘাতে উত্তেজনা কমানোর লক্ষে একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারের সমর্থক ইরান। আর আসাদকে উৎখাতে লড়াইরত বিরোধী যোদ্ধাদের সমর্থন দিয়েছে সৌদি আরব। সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই চুক্তিটিকে অঞ্চলটির নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা জোরদার করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ইসরায়েলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় প্রধান ইয়ার লাপিদ রিয়াদ ও তেহরানের চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি এটিকে, ইসরায়েলি সরকারের পররাষ্ট্রনীতির পুরোপুরি ও বিপজ্জনক ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ইরানকে মোকাবিলা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার না করে যখন সারাদিন আইনি জটিলতায় পড়ে থাকতে হয় তখন এমনটিই ঘটে। আরেক বিরোধী দলীয় আইনপ্রণেতা গিদিয়ন সার সৌদি আরবের সঙ্গে নেতানিয়াহুর শান্তি পরিকল্পনার লক্ষ্য নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন। তিনি লিখেছেন, সৌদি আরবের শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নেতানিয়াহু। শেষ পর্যন্ত সৌদি আরব তা করেছে ইরানের সঙ্গে। ইতালিতে রাষ্ট্রীয় সফরে থাকা নেতানিয়াহু চুক্তির বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতিও প্রকাশ করেননি। তবে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম অজ্ঞাত সিনিয়র কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে বলেছে, নেতানিয়াহুর সঙ্গে থাকা প্রতিনিধি দল নেতানিয়াহু পুনরায় ক্ষমতায় আসার আগের সরকারের ওপর দায় চাপাতে চাইছে। এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, এটি ঘটেছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল, এমন একটি ছাপ পড়ার কারণে। দৈনিক পত্রিকা হারেৎজ ইঙ্গিত এই সিনিয়র কর্মকর্তা খোদ নেতানিয়াহু।