November 12, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, March 3rd, 2023, 3:25 pm

৫০ বছর পর আলোর মুখ দেখছে সিলেটের এক বধ্যভূমি

জেলা প্রতিনিধি, সিলেট :

গুয়েতেমালা টর্চার সেলের চেয়েও নিকৃষ্ট ছিল সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমি। একাত্তরে এখানে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সেই ক্যাম্পে ধরে আনা হত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ সমর্থকদের। তারপর চলত ভয়ংকর নির্যাতন। তিলেতিলে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হতো।

এমনকি অন্তত কয়েকশ’ নারীকেও এখানে এনে রাখা হয়েছিল। পাশবিক নির্যাতনের মুখে তাদের চিৎকারে বাংলার আকাশ আর মাটি কেঁপে উঠলেও কাঁপেনি তাদের পাষাণ হৃদয়। মৃত্যুই ছিল তাদের পরিণতি।

এতদিন ঝোপঝাড়ের আড়ালেই ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই গৌরবময় অধ্যায়। সবাই জানতেন, এখানে একটা বধ্যভূমি আছে। কিন্তু তা পড়ে আছে নেহায়েত হেলাফেলায়। কেউ হয়ত এখানে দাঁড়িয়ে সুরা এখলাস পড়তে পড়তে চোখের জল মুছেছেন। সার্বিক পরিবেশ দেখে হয়ত কেউকেউ হয়ত আত্মধিক্কারও দিয়েছেন।

সেই অসহনীয় পরিবেশকে সহনীয় এবং দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে কাজ শুরু করেন সিলেটেরই দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাদের একজন আবার শহীদ পরিবারের সদস্য। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ডাক্তার জিয়া উদ্দিন আহমদ ও কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতিক।

ডাক্তার জিয়া উদ্দিন আহমদ সিলেটের শহীদ ডাক্তার শামসুদ্দিন আহমদের ছেলে। একাত্তরের রনাঙ্গনে তিনিও লড়েছিলেন দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য। আর দুর্ধর্ষ বীর কর্নেল সালামকেতো তার অসামান্য অবদানের জন্য সরকার বীর প্রতিক খেতাবে ভুষিত করেছেন।

তাঁরা দু’জনের উদ্যোগে নিজেদের পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবের দেয়া টাকায় একাত্তরের এই বধ্যভূমিকে আলোর মুখ দেখানোর কাজ শুরু করেন।

সম্প্রতি সিলেটে অনুষ্ঠিত দু’টি অনুষ্ঠানে তারা জানান, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস- ইত্যাদি উদযাপন করা হয় সাড়াম্বরে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে দৃশ্যমান করার কোন উদ্যোগ কেউ নেয়না। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে রাস্তাঘাটের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করা হলেও সিলেটে এই প্রবনতা নেই বললেই চলে।

এমনকি ঢাকা বা চট্টগ্রামে সিলেটের মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সড়ক থাকলেও সিলেটের মানুষজন তাদের নামই জানেন না। যদি এটা করা হতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধটা আরও দৃশ্যমান হতো।

এরই তাগিদে তারা সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন এই বধ্যভূমিকে তারা একটা মেমোরিয়াল গার্ডেন হিসাবে গড়ে তুলবেন। এটা আর দশটা স্মৃতিসৌধের মতো হবেনা। এখানে শহীদদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকবে, কবরগুলো চিহ্নিত করে যতটা সম্ভব তাদের নাম ঠিকানা লেখা থাকবে, থাকবে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও। ২০১৭ সাল থেকেই তারা তাদের এই চিন্তাভাবনা বাস্তবায়ন করতে মাঠে নামেন।

এই জায়গাটির মালিকানা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। তাই সেনাপ্রধানের কাছে তারা বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি সায় দেন। এরপর বর্তমান সেনাপ্রধান ও সিলেটের এরিয়া কমান্ডারও সাড়া দেন। তাদের সম্মতি পেয়ে সরকারী সাহায্য সহযোগীতার অপেক্ষায় না থেকে ডাক্তার জিয়া ও কর্নেল সালাম নিজেদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তহবিল সংগ্রহ করতে থাকেন। এগিয়ে আসেন তাদের অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনও।

মূলতঃ তাদের দেয়া টাকায় দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজ শুরু করেন। কর্নেল সালাম বীর প্রতিক জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত এই বধ্যভূমিতে শহীদ হয়েছেন, এমন ৬১ জনের পরিচয় উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। তাদের নাম লেখা হয়েছে। স্মৃতিসৌধও হয়েছে। মোটামুটি প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ। এখন যেসব শহীদের পরিচয় উদ্ধার সম্ভব হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই বধ্যভূমি উন্মুক্ত করা হবে আগামী ৪ মার্চ শনিবার।

এখানেই শেষ নয়। তাদের অনুসন্ধান চলতে থাকবে। এখানে প্রচুর লোককে হত্যা করা হয়েছে। যখন যার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে- তখনই তা লিপিবদ্ধ করা হবে।

কর্নেল সালাম বীর প্রতিক আরও জানান, এতদিন ঝোপঝাড়ের আঁধারে নিজেদের শহীদ স্বজনদের কবরগুলো দেখে যাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে আমরা দেখেছি। এবার হয়ত সেই ক্ষরণ কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। এই বধ্যভূমির সৌন্দর্যবর্ধন আমরা এমনভাবে করতে চাই যে, যাতে পর্যটকরাও এখানে এসে স্বস্তিতে সময় কাটানোর পাশাপাশি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং এই বধ্যভূমির শহীদদের সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা লাভ করতে পারেন।

এদিন বিকেলে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শহীদ পরিবারগুলোর সদস্যদের হৃদয়ে রক্তক্ষরনের গল্পও শুনবেন সিলেটবাসী। তাদের সংবর্ধনা দেয়া হবে বলেও জানালেন এই দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা।