নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীতে পানির চাহিদা মেটতে ওয়াসা দিনে যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করছে তার ৬৬ শতাংশই ভূগর্ভস্থ। নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদেরা বলছেন, অবিরাম ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করতে থাকলে ঢাকায় ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে। ওয়াসাকে মাটির নিচের পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশোধন করে সরবরাহে। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র এর উল্টো। গত এক যুগে গভীর নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন এলাকার এক হাজার ২৭২টি কূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির বাড়া-কমা পর্যবেক্ষণ করে সংস্থাটি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯৯০ সালে ১৩০টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হতো। তখন পানি পাওয়া যেত সাড়ে ২২ মিটার নিচ থেকে। ২০০৫ সালে নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪২৩, পানির স্তর নামে ৫৪ মিটারে। ২০২২ সালে এসে নলকূপের সংখ্যা ৯শ ছাড়িয়ে গেছে। আর পানির স্তর নেমেছে অন্তত ৮০ মিটারে। জানা গেছে, ২০০৯ সালে মাটির নিচের পানি ব্যবহার কমিয়ে নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে রাজধানীর মানুষের চাহিদা মেটাতে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি নিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। তখন বলা হয়েছিল গভীর নলকূপ কমিয়ে নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানো হবে। উৎপাদন করা হবে টেকসই, গণমুখী ও পরিবেশবান্ধব পানি। কিন্তু গত এক যুগে উল্টো ঢাকায় গভীর নলকূপ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ওয়াসার প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানা যায়, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার গভীর নলকূপের সংখ্যা ছিল ৫১৯টি। এরপর প্রতিবছরই নতুন নতুন নলকূপ বসানো হয়েছে। এসব নলকূপ থেকে দিনরাত অবিরাম তোলা হচ্ছে পানি। এতে ঢাকায় পানির স্তর প্রতি বছর নেমে যাচ্ছে গড়ে প্রায় পাঁচ ফুট করে। বাড়ছে পানি তোলার খরচও। অর্থাৎ, ১০ বছর আগে একটি গভীর নলকূপ বসাতে খরচ হতো ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। এখন খরচ হয় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, এক যুগ আগেও ঢাকায় পানি সরবরাহে বেশ ঘাটতি ছিল। তখন দিনে পানি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৮৮ কোটি লিটার। পরে পানি সরবরাহ দ্রুত ও বহুমুখী করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় ওয়াসা। এই পদক্ষেপে তারা গভীর নলকূপ স্থাপনে বেশি গুরুত্ব দেয়। এখন নগরে গভীর নলকূপের সংখ্যা ৯০৬টি। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় (জোন-১) ৮১টি, পুরান ঢাকায় (জোন-২) ৭০টি, ধানমন্ডি এলাকায় (জোন-৩) ১৩৭টি, মিরপুর-১ (জোন-৪) ১১৫টি, গুলশান-মহাখালীতে (জোন-৫) ৭৭টি, ফকিরাপুলে (জোন-৬) ১১৮টি, শনির আখড়া, মাতুয়াইলে (জোন-৭) ৫৬টি, বাড্ডায় (জোন-৮) ৭৩টি, উত্তরায় (জোন-৯) ৭৫টি, মিরপুর ১০ (জোন-১০) ১০৪টি। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আরও অন্তত ২০টি নলকূপ স্থাপনের কাজ চলছে। জানা যায়, ২০১৪ সালে সাভারের ভাকুর্তায় ৫৭২ কোটি টাকা খরচ করে একসঙ্গে ৪৬টি গভীর নলকূপ বসায় ঢাকা ওয়াসা। এ নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এখন ১৫ কোটি লিটার পানি উত্তোলনে সক্ষম এই প্রকল্পের পানি ঢাকার মিরপুরে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার সরবরাহের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। ফলে মিরপুর এলাকায় পানি সংকট তীব্র হয়েছে। মহাখালী, বনানী, গুলশান ঢাকা ওয়াসার জোন-৫ এর আওতাধীন। ২০১৯ সালে এই এলাকাগুলোতে পানির তীব্র সংকট ছিল। তখন এই জোনের বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে আটটি নতুন নলকূপ স্থাপনে অনুমোদন দেয় ওয়াসা। এর মধ্যে মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ) সংলগ্ন মন্দির গলিতে একটি নলকূপ স্থাপন করা হয়। এই কূপ থেকে আড়াই হাজার গ্রাহককে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। জোন-৫ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তৌহিদ এলাহী জানান, তার জোনে পানি সরবরাহ করতে ওয়াসার নলকূপ রয়েছে ৭৭টি। গ্রাহকদের বাসাবাড়ি বা অফিসে যে পানি সরবরাহ করা হয় তার ৮০ শতাংশই নলকূপের। বাকি ২০ শতাংশ পানি ভূ-উপরিস্থের। এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডের বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী, এই ওয়ার্ডগুলোতে দুই কোটির বেশি মানুষের বাস। সেখানে গ্রাহক সংখ্যা তিন লাখের বেশি। তাদের পানির চাহিদা মেটাতে দিনে ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। এর মধ্যে শতকরা ৩৪ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাকি ৬৬ শতাংশ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। তবে সিস্টেম লসের (অপচয়) কারণে দিনে প্রায় ৫০ কোটি লিটার পানি গ্রাহক পর্যন্ত যায় না। এতে শহরে পানির ঘাটতি থাকছেই। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসীম এ খান বলেন, ২০২৩ সাল নাগাদ ঢাকা শহরে সরবরাহ করা পানির ৭০ শতাংশ আসবে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ। এভাবেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ বা নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানো হবে। এটি বাস্তবায়নে এরইমধ্যে বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ধীরগতি রয়েছে। মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করতে ৯ বছর আগে সোয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল ওয়াসা। তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পরও এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। এখন এই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা। শোধনাগার ও পানির লাইনের নির্মাণকাজ শেষে কবে নাগাদ মেঘনা নদীর পানি ঢাকাবাসী পাবে সেটি নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। অন্যদিকে পদ্মা নদীর পানি রাজধানীতে সরবরাহ করতে তিন হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু শোধনাগার থেকে পানি রাজধানীতে নিতে সরবরাহ লাইনই স্থাপন করেনি ওয়াসা। এতে শোধনাগারের সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে দুই বছরের বেশি সময় ধরে। ফলে নির্ধারিত সময়ে ভূ-উপরিস্থ পানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না ওয়াসা।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি