নিজস্ব প্রতিবেদক:
আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান কথাটি শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। আদতে আইনের চোখ প্রবলভাবে পক্ষপাতদুষ্টে আক্রান্ত। তাই আইনের চোখের আলো সবার ওপর সমানভাবে পড়ে না। এতে অনেকে যেমন লাভবান হন, অনেকে হন নিগৃহীত। জানা যায়, অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি হয় না প্রশাসন কর্মকর্তাদের। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের ডিসি, এডিসি, ইউএনও এবং সহকারী কমিশনারসহ শত শত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এসব কর্তকর্তাদের মধ্যে অনেকেই পদোন্নতি পেয়েছেন আবার অনেকেই গুরুদ- ও লঘুদ-, তিরস্কার, বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, ছাড় পাচ্ছেন প্রশাসনের ক্ষমতাধর কর্মকর্তারা। এ যেন জর্জ অরওয়েলের ‘এনিমেল ফার্ম’ উপন্যাসের সেই কালজয়ী বাণী স্মরণ করিয়ে দেয়–সবাই সমান, কিন্তু কেউ কেউ একটু বেশি সমান। অর্থাৎ রাষ্ট্র সমান তত্ত্বে বিশ্বাসী হলেও রাষ্ট্রের কেউ কেউ একটু বেশি সুবিধা পেয়ে থাকবে। সম্প্রতি এমন ঘটনাই ঘটেছে। সাবেক দুইজন জেলা প্রশাসককে বিভাগীয় মামলায় শাস্তি দেয়া হলেও পরে প্রেসিডেন্ট তাদের দ- মওকুফ করে দিয়েছেন। সেই কর্মকর্তারা আবার পদোন্নতি পাচ্ছেন। অথচ সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ অনুয়ায়ী বিভাগীয় মামলার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের হাতে সেই পুলিশের মধ্যেই বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। প্রায়শ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা। আগে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তারা সাধারণ অপরাধে জড়ালেও এখন ছিনতাই, মাদক-নারী নির্যাতনসহ বড় অপরাধে জড়াচ্ছেন এসপি পর্যায়ের কর্মকর্তারাও। মাঠ পর্যায়ের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের পেশাদার ও যোগ্য কর্মকর্তাদের পড়তে হচ্ছে বিব্রতকর অবস্থায়।
সূত্র জানায়, নানা অপরাধে জড়িয়ে প্রতি বছর গড়ে প্রায় দুই হাজার পুলিশ সদস্য চাকরি হারাচ্ছেন। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, নির্যাতন, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পুলিশ সদস্যদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। অনেককে নানা লঘুদন্ড দেয়া হচ্ছে। চাকরিচ্যুত করেই যেন শাস্তি শেষ। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুলিশে বড় ধরনের অপরাধ করে সাজা মিলছে কম। সাজা অনেকটা ‘লোক দেখানো’ গোছের। বড় অপরাধকেও ছোট করে দেখা হচ্ছে। আবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত করতে গিয়ে কোনো ‘অপরাধ’ খুঁজে পায় না পুলিশ। কথিত ইমেজ রক্ষার নামে আড়াল করা হচ্ছে পুলিশের অপরাধ কর্মকান্ড। অথচ গুটি কয়েকজনের জন্য পুরো বাহিনীর সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে।
পুলিশের প্রতি পুলিশের টান থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই টান অবশ্যই ভাল মানুষের জন্য হওয়া উচিত। যে পুলিশ মানুষ হিসেবে ভাল, দেশের জন্য যার ত্যাগ আছে তার প্রতি শুধু অন্যান্য পুলিশ কেন, সাধারণ মানুষেরও টান থাকবে। কিন্তু অপরাধপ্রবন পুলিশকে প্রশ্রয় দেওয়া কোনভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু দেশে এই ব্যাপারটাই দেখা যাচ্ছে বলে জানা গেছে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা অপরাধী পুলিশ সদস্যকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্যই নানা চেষ্টা-তদবির করছেন। ফলে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। তদন্তের নামে চলছে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ। একপর্যায়ে ভুক্তভোগীরাও হতাশ হয়ে পিছুটান দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার ভুক্তভোগীদের ভয়-ভীতি দেখানো তো হরহামেশাই ঘটছে। এতে অপরাধে আরো ‘উৎসাহী’ করে তুলছে সাজাপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যকে। ফলে অপরাধ করেও সেই পুলিশ সদস্য পার পেয়ে যাচ্ছেন নিমিষেই।
পুলিশ অপরাধে জড়িয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাদের জেল-জরিমানা হয় না। বাংলাদেশ পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি) অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে প্রাথমিক শাস্তি হিসেবে তাকে কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করা হয়। বিধিমালা অনুযায়ী, অনেক সময় ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সাময়িক বরখাস্ত করা হলে সঙ্গে প্রত্যাহার করা হয়ে থাকে। তবে শুধু প্রত্যাহার করা হলে সাময়িক বরখাস্ত নাও করা হতে পারে। বরখাস্ত করা হলে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য নিয়মিত বেতন না পেলেও শাস্তি চলাকালীন নির্দিষ্টহারে ভাতা পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে প্রত্যাহার করা হলে তার কর্মস্থল পরিবর্তন হলেও তিনি সব ধরনের সুবিধাই পেয়ে থাকেন। পরে অভিযোগ প্রমাণিত হলেই কেবল সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-১৯৮৫ অনুযায়ী অভিযুক্ত এসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
পুলিশ বাহিনীতে মূলত চার ধরণের শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। এগুলো হলো–গুরুদন্ড, লঘুদন্ড, চাকরিচ্যুতি ও বাধ্যতামূলক অবসর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের শাস্তি বদলি, প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পুলিশ সদর দফতরে দেওয়া তথ্যমতে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাহিনীর প্রায় ৭৭ হাজার সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রায় ৩৭ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতির মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারিসহ বিভাগীয় মামলায় সাজা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অপরাধে জড়ানোর হার কমছে না। দিন দিন বরং অপরাধ আরও বাড়ছে।
অপরাধ প্রতিরোধকারী যখন অপরাধে লিপ্ত হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই অপরাধটা আরও গুরুতর হিসেবে ধরা উচিত। সেক্ষেত্রে তাদের শাস্তিও কঠিন হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তব চিত্র তার উল্টো। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, পুলিশি অপরাধের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। এর মধ্যে যেসব ঘটনা ফাঁস হচ্ছে, কেবল সেগুলোই আলোচনায় আসছে। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে। আবার এসব প্রতিবেদনের বেশির ভাগই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের পক্ষে। সাজাপ্রাপ্তদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে। কনস্টেবল থেকে এসআই পদের সদস্যরা ফৌজদারি অপরাধসহ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতি লঙ্ঘনে সবচেয়ে বেশি জড়াচ্ছেন। তবে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেলায় এই হার একেবারেই নগণ্য।
তবে শুধু শাস্তি নিশ্চিত করলেই যে পুলিশ অপরাধ থামবে তা যুক্তিযুক্ত নয়। এটি অন্যান্য অপরাধীদের ক্ষেত্রেও একই কথা। অপরাধের পেছনের কারণ খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভাষ্য, আমাদের সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। পুলিশ এদের বাইরে নয়। মানুষ যখন প্রলুব্ধ হয় তখন অপরাধ করে। শারীরিক ও মানসিক কারণেও অপরাধ করে থাকে। এসব মৌলিক কারণেই অপরাধ করে মানুষ। শুধু শাস্তি দিয়েই পুলিশ বাহিনীকে অপরাধে জড়ানো থেকে দূরে রাখা যাবে না। যে সব কারণে অপরাধ হয় সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পুলিশ বাহিনী তার জন্য চেষ্টা করছে।
আরও পড়ুন
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
সাগর-রুনি হত্যা মামলা তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ
কমতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামের নদীর পানি, ভাঙন আতঙ্কে মানুষ